বুধবার

১২ নভেম্বর, ২০২৫ ২৮ কার্তিক, ১৪৩২

টেলিকম খাতের নিয়ন্ত্রণ এখনো আ.লীগের হাতে; ঝুঁকিতে জাতীয় নিরাপত্তা!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ৯ নভেম্বর, ২০২৫ ১৯:২৬

আপডেট: ৯ নভেম্বর, ২০২৫ ১৯:৩৩

শেয়ার

টেলিকম খাতের নিয়ন্ত্রণ এখনো আ.লীগের হাতে; ঝুঁকিতে জাতীয় নিরাপত্তা!
ছবি: বাংলা এডিশন

ইন্টারনেট অবকাঠামো শুধু ডিজিটাল অগ্রযাত্রার মাধ্যমই নয়—এর ওপরই নির্ভর করে জাতীয় নেটওয়ার্কের গতি-প্রকৃতি, স্বচ্ছতা এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা।

কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই দেশের এমন স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ খাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠছে। সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও—রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করার পরিবর্তে—গুটিকয়েক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর লুটপাটের পথ সুগম করতে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা হয়েছে, এমন অভিযোগও রয়েছে।

গেল দেড় বছরে বদলেছে প্রেক্ষাপট। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে এসেছে নতুন মুখ, পরিবর্তনের নানা আশ্বাসও দিয়েছে সরকার। তবে, ঘুরেফিরে অন্য অনেক খাতের মতো দেশের গুরুত্বপূর্ণ সাইবার সিস্টেমও গিলে খাচ্ছে সেই পুরনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। শুধু তাই নয়, ব্যান্ডউইথ সরবরাহে ভারত-নির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ নিলেও, উচ্চ আদালতে সেটি বাতিলের আবেদনও করা হয়েছে!

সম্প্রতি বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিপিএলসি)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের এক ফেসবুক পোস্টে উঠে এসেছে এমনই ভয়াবহ তথ্য। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি, গণমাধ্যম এবং অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সূত্র বলছে—আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইথ সরবরাহের ক্ষেত্রে অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ সাবমেরিন কেবল সংযোগের চেষ্টা চলছে বেশ জোরেশোরেই।

১৮ অক্টোবরের সেই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিএসসিপিএলসি’র মাধ্যমে ট্রাস্টেড ও আন্তর্জাতিক মানের কানেকটিভিটির জন্য পর্যাপ্ত ব্যান্ডউইথ সরবরাহের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, বেসরকারি উদ্যোগে ‘আনট্রাস্টেড’ এবং ঝুঁকিপূর্ণ সাবমেরিন কেবল সংযোগের চেষ্টা চলছে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সরবরাহকৃত ব্যান্ডউইথ ব্যবহারের আহ্বান জানানো হয়েছে।

এর আগে, বিএসসিপিএলসি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসলাম হোসেন তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন—২০২২ সালে তিনটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান “অন্যায্য প্রভাব” খাটিয়ে সাবমেরিন কেবল লাইসেন্স পেয়েছে। অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও, লাইসেন্স পাইয়ে দিতে একাধিকবার পরিবর্তন করা হয়েছে লাইসেন্সিং গাইডলাইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারাও।

সেই ধারায় বলা ছিল—সর্বোচ্চ স্কোরপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানকেই দেওয়া হবে লাইসেন্স। তবে, নিয়ম পাল্টে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়ার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। এখন তারা আলাদা লাইসেন্স নিয়েও একীভূত হয়ে কনসোর্টিয়াম গঠন করে একটি মাত্র বিদেশি কেবলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছে।

বিএসসিপিএলসি’র এমডির দাবি, এই সংযোগ হতে যাচ্ছে ‘Sigma’ বা Singapore–Myanmar সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে, যা নির্মাণ করেছে চীনা প্রতিষ্ঠান Huawei Marine Network (HMN)। এই কেবলটি পুরনো ও অনির্ভরযোগ্য, যার প্রায় ৯০ শতাংশ অবস্থান মিয়ানমারের অগভীর জলসীমায়। ফলে, ক্ষতিগ্রস্ত হলে মেরামতের জন্য মিয়ানমার সরকারের অনুমতি নিতে হবে—যা সরাসরি বাংলাদেশের ডিজিটাল সার্বভৌমত্বকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।

এরই মধ্যে HMN যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া কর্তৃক “Untrusted Vendor” হিসেবে তালিকাভুক্ত। ফলে, এই নেটওয়ার্কে যুক্ত হলে বাংলাদেশও হয়ে পড়বে একটি “Untrusted Submarine Cable System”-এর অংশ।

আসলাম হোসেন আরও লিখেছেন—এই সংযোগ যুক্ত হলে Google, Meta, Amazon-এর মতো হাইপারস্কেল ডেটা সেন্টার বাংলাদেশে নিরাপদ নেটওয়ার্ক স্থাপনে অনাগ্রহী হতে পারে। এর ফলে আন্তর্জাতিক সংযোগ ও ক্লাউড সেবায় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে।

দেশে যেভাবে সাইবার হামলার ঝুঁকি বাড়ছে, তাতে অনির্ভরযোগ্য এ ধরনের সংযোগে যুক্ত হওয়া মানে জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনীতিকে একসঙ্গে ঝুঁকির মুখে ফেলা—বলেই মনে করেন তিনি।

এদিকে, লাইসেন্সপ্রাপ্ত তিন প্রতিষ্ঠান—সামিট কমিউনিকেশনস, মেটাকোর ও সি-ডিনেট—এরই মধ্যে প্রচার তৎপরতা জোরদার করেছে। বিভিন্ন সূত্র বলছে, বিভ্রান্তিকর তথ্য ও প্রভাব খাটিয়ে তারা দ্রুত প্রকল্প অনুমোদনের চেষ্টা করছে। শুধু তাই নয়, সি-ডিনেট কমিউনিকেশনস লিমিটেডের একটি অভ্যন্তরীণ সভার সিদ্ধান্ত থেকে জানা গেছে—সরকারের অনাপত্তি ছাড়াই অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় থেকে কেবল শিপে কেবল লোড করাও শুরু করেছে তারা।

লাইসেন্সিং অথরিটি বিটিআরসিও জানায়—কেবল লেইংয়ের জন্য এখনো অনুমতি দেওয়া হয়নি তাদের।

বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. এমদাদ উল বারী বলেন,
“লাইসেন্স প্রক্রিয়া ছাড়াও বেসরকারি তিন প্রতিষ্ঠানের মালিকানা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সামিট কমিউনিকেশনসের ৪৯ শতাংশ শেয়ার দুবাইভিত্তিক Global Energies Holdings-এর, যার মালিক আজিজ খানের মেয়ে আদিবা আজিজ খান। বিদ্যুৎসহ নানাখাতে দুর্নীতি ও অর্থপাচারের অভিযোগ থাকলেও, হাসিনা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি পার পেয়ে গেছেন—এমন অভিযোগও রয়েছে।”

অন্যদিকে, মেটাকোরের মূল মালিক Level Three, যার বিরুদ্ধে ব্যান্ডউইথ চোরাচালানের অভিযোগে বিটিআরসি জরিমানা করেছিল ১০ কোটি টাকা। তাদের ২০ শতাংশ শেয়ার Velocity Networks-এর, ৩০ শতাংশ Amber IT-এর সিইও আমিনুল হাকিমের, এবং অংশীদার হিসেবে রয়েছেন সাবেক সেনাপ্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক।

সি-ডিনেটের মালিকানা যুক্ত Strategic Finance ও Jaran of Dock Ltd.-এর সঙ্গে, যেখানে রয়েছেন আওয়ামী লীগ আমলে দুর্নীতির বরপুত্র খ্যাত চৌধুরী নাফিজ শরাফত ও ইস্টার্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান শওকত আলী। বিএফআইইউ জানায়, শওকত আলীর পরিবারের অ্যাকাউন্টে ৮ হাজার কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

অর্থাৎ, অনিয়ম-দুর্নীতির বাইরেও এই তিন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পতিত সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বারবার প্রমাণিত। রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, এই তিন প্রতিষ্ঠানকেই নতুন করে সাবমেরিন কেবলের মতো সংবেদনশীল খাতে যুক্ত করা কতটা যৌক্তিক—সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিটিআরসি চেয়ারম্যান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাবমেরিন কেবল শুধু ইন্টারনেট পাইপ নয়—এটি দেশের ডিজিটাল সার্বভৌমত্বের প্রতীক। বিদেশি নির্ভরতা বা ‘Untrusted’ নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়া মানে জাতীয় নিরাপত্তার ওপর সরাসরি হুমকি।

বিএসসিপিএলসি’র সাবেক এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে সাবমেরিন কেবল স্থাপনে কনসোর্টিয়াম পদ্ধতিতে অধিকাংশ মালিকানা থাকে রাষ্ট্রীয় টেলিকমিউনিকেশন প্রতিষ্ঠানের হাতে। ফলে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তা থাকে সুরক্ষিত। তবে, শুধুমাত্র বেসরকারি মালিকানায় গঠিত কনসোর্টিয়ামের ক্ষেত্রে সেই কাঠামো কার্যকর হয় না।

তিনি আরও বলেন, দেশের বর্তমান ব্যান্ডউইথ চাহিদা পূরণে বিএসসিপিএলসি পুরোপুরি সক্ষম। বিকল্প সংযোগ ব্যবস্থাও রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। তাই নতুন করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

এদিকে, সংশ্লিষ্টরা বলছেন—ভারতে স্থাপিত কনটেন্ট ডেলিভারি নেটওয়ার্ক (CDN) ব্যবহারে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও তথ্য নিয়ন্ত্রণ উভয় ক্ষেত্রেই ঝুঁকি থেকে যায়। দেশের অভ্যন্তরে CDN স্থাপন করা গেলে Google, Meta’র মতো আন্তর্জাতিক কোম্পানি বাংলাদেশের ভেতরেই ডেটা সেন্টার স্থাপন করতে পারবে। এতে আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইথের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে রাজস্ব আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে।

সাবমেরিন কেবল প্রযুক্তিতে সর্বশেষ উদ্ভাবন ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল পিএলসি এরই মধ্যে দেশের চাহিদা পূরণে যথেষ্ট সক্ষমতা অর্জন করেছে বলে উল্লেখ করে, সাবমেরিন সাইবার সিস্টেম ও সামাজিক যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে দেশে CDN স্থাপন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত জরুরি বলেও মন্তব্য করেন এই কর্মকর্তা।

বিএসসিপিএলসি’র হিসাব অনুযায়ী, তাদের তিনটি সাবমেরিন কেবল বাংলাদেশের বর্তমান ও আগামী ব্যান্ডউইথ চাহিদা অনায়াসেই পূরণ করতে সক্ষম। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান টেলি জিওগ্রাফির ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—২০২৭ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ব্যান্ডউইথ চাহিদা হবে প্রায় ১৪,৮০০ জিবিপিএস, যা বিএসসিপিএলসি’র সক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে।

সাবমেরিন কেবল, ডেটা-ব্যান্ডউইথ কিংবা সাইবার সিস্টেম—কেবল প্রযুক্তিগত গল্প নয়; এসবই একটি দেশের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাধীনতার প্রশ্নও বটে। তাই সাবমেরিন কেবল সংযোগও কেবলমাত্র প্রযুক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়—এক অর্থে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার চূড়ান্ত সীমারেখা। যা নির্ধারণ কিংবা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে দেশের স্থিতিশীলতা, প্রপাগান্ডা এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতিও।

তাই এই খাতের চাবিকাঠি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নজরদারিতে থাকবে—এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।



banner close
banner close