আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা, প্রতিযোগিতা আর চাপ মানুষের হৃদয়ে ক্রমশ হতাশা ও উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দিচ্ছে। অনেক সময় মানুষ নিজেকে একা ও অসহায় মনে করে। অথচ কোরআন ও সুন্নাহ আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়—আল্লাহর দয়া থেকে নিরাশ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহর ওপর ভরসা শুধু মানসিক আশ্বাস নয়; এটি একজন মুমিনের ঈমানের শক্ত ভিত্তি। সবচেয়ে সংকটময় মুহূর্তেও এই ভরসাই মানুষকে স্থির ও দৃঢ় রাখে।
আশা মানে কেবল ভবিষ্যৎ নিয়ে কল্পনা নয়; বরং ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সামনে এগিয়ে চলার সাহস। ইসলামের দৃষ্টিতে আশা হলো এমন এক আত্মিক শক্তি, যা মানুষকে ভয়, দুশ্চিন্তা ও বিপদের মাঝেও টিকে থাকতে সহায়তা করে। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা রাখে, সে কখনো সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে না।
আজকের ব্যস্ত জীবনে আমরা প্রায়ই এই ভরসা ও আশার গুরুত্ব ভুলে যাই। দুনিয়াবি কাজকর্ম ও চিন্তায় ডুবে গিয়ে আল্লাহর ওপর নির্ভরতা কমে আসে। অথচ আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য হতাশার বিপরীতে অগণিত আশার দরজা খুলে রেখেছেন। যখন জীবনের অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, তখন মনে রাখা জরুরি—আল্লাহ নিজেই আমাদের তাঁর রহমত ও ক্ষমার দিকে ফিরে আসতে আহ্বান জানিয়েছেন।
ইসলামের শিক্ষা হলো, একজন ঈমানদার সব পরিস্থিতিতেই ভালো পরিণতির আশা করবে এবং আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী চলবে। এতে দুনিয়া ও আখিরাত—উভয় ক্ষেত্রেই কল্যাণ নিশ্চিত হয়।
আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি জানেন, মানুষের জীবনে দুর্বলতার মুহূর্ত আসবেই। তাই কোরআন ও হাদিসে বারবার বলা হয়েছে—আল্লাহর দয়া, ক্ষমা ও রহমত থেকে কখনো নিরাশ হওয়া যাবে না।
মানুষ কেন আশা হারিয়ে ফেলে?
অনেক সময় পাপের বোঝা মানুষকে মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলে। ভুল করার পর অনুশোচনা বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় পৌঁছে যায়, যেখানে মানুষ ভাবতে শুরু করে—আল্লাহ হয়তো আর তাকে ক্ষমা করবেন না। এই চরম হতাশাই শয়তানের সবচেয়ে বড় কৌশল, যার মাধ্যমে সে মানুষকে আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
কিন্তু আল্লাহ বলেন—বান্দা আমার সম্পর্কে যেমন ধারণা করে, আমি তার সঙ্গে তেমনই আচরণ করি। বান্দা যদি আমার দিকে এক কদম এগোয়, আমি তার দিকে বহু কদম এগিয়ে যাই। এই বাণী একজন বিশ্বাসীর অন্তরে সীমাহীন আশা জাগিয়ে তোলে।
পাপ যত বড়ই হোক, আল্লাহর রহমত তার চেয়েও বিশাল
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবিরা নিষ্পাপ ছিলেন না। তারাও মানুষ ছিলেন, ভুল করেছেন, পাপেও জড়িয়েছেন। কিন্তু তারা জানতেন—আল্লাহর ক্ষমার দরজা কখনো বন্ধ হয় না। কোনো পাপই আল্লাহর রহমতের চেয়ে বড় নয়।
এমনকি ফেরাউনের মতো সীমালঙ্ঘনকারীর প্রতিও আল্লাহ মুসা (আ.)-কে নরম ভাষায় কথা বলার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে সে অনুতপ্ত হওয়ার সুযোগ পায়। তাহলে আমাদের গুনাহ কীভাবে আল্লাহর ক্ষমার বাইরে হতে পারে?
কোরআনে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট ভাষায় মানুষের হৃদয়ে আশার আলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন। সূরা আয-যুমার (৩৯:৫৩)-এ তিনি ঘোষণা করেন—
“হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে কখনো নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহ ক্ষমা করেন। তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”
এই আয়াত প্রমাণ করে, মানুষের পাপ যত বড়ই হোক না কেন, আল্লাহর রহমত তার চেয়েও অনেক বেশি বিস্তৃত। হতাশা কখনো মুমিনের পথ হতে পারে না। বরং আল্লাহ নিজেই আমাদের তাঁর দিকে ফিরে আসতে, ক্ষমা চাইতে এবং আশায় বুক বাঁধতে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া নয়—বরং তাঁর ওপর পূর্ণ ভরসা রাখাই ঈমানের প্রকৃত পরিচয়।
দুশ্চিন্তা ও হতাশা থেকে মুক্তির উপায়
বর্তমান সময়ের অন্যতম বড় সমস্যা মানসিক চাপ ও উদ্বেগ। তবে এটি নতুন কোনো বিষয় নয়। যুগে যুগে মানুষ পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে, আর নবী-রাসুলরা মানুষকে আশা ও আল্লাহর ওপর ভরসার শিক্ষা দিয়েছেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—যে ব্যক্তি বেশি বেশি ইস্তিগফার করে, আল্লাহ তার দুশ্চিন্তা দূর করে দেন এবং অপ্রত্যাশিত উৎস থেকে তাকে রিজিক দান করেন। তিনি আরও বলেছেন—দোয়া করো এবং দৃঢ় বিশ্বাস রাখো যে আল্লাহ দোয়া কবুল করবেন।
উদ্বেগ ও হতাশা দূর করার জন্য রাসুল (সা.) যে দোয়াটি শিখিয়েছেন, তা আজও সমানভাবে কার্যকর। এতে দুশ্চিন্তা, অলসতা, ভয়, ঋণের চাপ এবং মানুষের কর্তৃত্ব থেকে আশ্রয় চাওয়া হয়।
কষ্টের পরেই আসে স্বস্তি
কোরআনে আল্লাহ বারবার আশ্বাস দিয়েছেন—প্রতিটি কষ্টের সঙ্গেই রয়েছে স্বস্তি। মানুষকে ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ ও প্রাণহানির মাধ্যমে পরীক্ষা করা হবে। তবে ধৈর্য ধারণকারীদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ।
এই দুনিয়ার জীবন পরীক্ষাময়, কিন্তু তা মোকাবিলা করতে হবে ধৈর্য ও আশার আলো নিয়ে। আশা মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে এগিয়ে নেয়, আর হতাশা মানুষকে স্থবির করে তোলে।
আল্লাহ অতি দয়ালু। এই পৃথিবীতে আমরা যে মমতা, সেবা ও করুণা দেখি—সবই আল্লাহর রহমতের মাত্র এক অংশ। বাকি ৯৯ শতাংশ তিনি কিয়ামতের দিনের জন্য সংরক্ষণ করে রেখেছেন। এটিই একজন মুমিনের জন্য সবচেয়ে বড় আশার কারণ।
মানসিক চাপ কখনো কখনো গভীর বিষণ্নতায় রূপ নিতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়াও আল্লাহর রহমতেরই অংশ। পাশাপাশি আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়া, ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং তাঁর ওপর ভরসা রাখাই একজন মুমিনের প্রকৃত পথ।
আরও পড়ুন:








