মুসলিম উম্মাহর সম্মিলিত ইবাদতের মহিমান্বিত আহ্বান জুমার নামাজ। কোরআন, সুন্নাহতে সর্বসম্মতভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, জুমা কোনো সাধারণ নামাজ নয়; বরং মুসলিম জীবনের পরিচয় ও ঈমানের দৃঢ়তার প্রতীক।
আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন, হে ঈমানদারগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের জন্য আহ্বান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে ছুটে যাও। (সুরা জুমা, আয়াত : ৯)
এ আহ্বান কোনো সাধারণ ডাকে সাড়া দেওয়ার নির্দেশ নয়; বরং এটি আল্লাহর ঘরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং আখিরাতের মুক্তির পথে অগ্রসর হওয়ার প্রশিক্ষণ।
নামাজ পরিত্যাগ কঠিন গুনাহ
ফরজ নামাজ ত্যাগ করা ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তাদের পরে আসল এমন এক অসৎ বংশধর যারা সালাত বিনষ্ট করল এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করল। সুতরাং শীঘ্রই তারা জাহান্নামের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে।(সুরা মারয়াম, আয়াত : ৫৯)
কেয়ামতের দিন জাহান্নামীরাও স্বীকার করে নেবে যে, আমাদের শাস্তির কারণ হলো, আমরা নামাজ আদায় করতাম না; মিসকিনকে খাদ্য দিতাম না…। (সুরা মুদ্দাসসির, আয়াত : ৪২-৪৭)
এসব আয়াত স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, নামাজ বিসর্জন দেওয়া কোনো হালকা ভুল নয়; বরং হৃদয়ের কঠোরতা, গাফিলতি, এবং ঈমানের শেকড় কেটে ফেলার নাম।
জুমা ত্যাগ আরও বড় বিপদ
জুমার নামাজ শুধু নামাজ নয়; এটি ইসলামী সমাজব্যবস্থার সাপ্তাহিক সমাবেশ। তাই অন্য কোনো সালাত ত্যাগের তুলনায় জুমা ইচ্ছাকৃত বর্জন আরও মারাত্মক অপরাধ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক করে বলেন: মানুষ যদি জুমার সালাত পরিত্যাগ করা থেকে বিরত না থাকে, আল্লাহ তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেবেন। (দারিমি, হাদিস : ১৫২৪)
আরও এসেছে, যে ব্যক্তি অলসতা করে পরপর তিন জুমা ছেড়ে দেয়, আল্লাহ তার অন্তরে মোহর মেরে দেন। (তিরমিজি, হাদিস : ৫০০; ইবনু মাজাহ, হাদিস : ১১২৫)
ইবনু আব্বাস (রা.) এর ভাষায়: যে তিন জুমা পরপর ত্যাগ করল, সে ইসলাম থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে দিল। (আবু ইয়ালা: ২৭১২)
নামাজ ত্যাগ, কুফরি কাজ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ইসলাম ও কুফরের মধ্যে বাধা হলো নামাজ। যে নামাজ ত্যাগ করে, সে কুফরি কাজে লিপ্ত হয়। (মুসলিম, হাদিস : ৮২)
হজরত ওমর (রা.) বলতেন: নামাজ ত্যাগকারী নিশ্চিত কাফের। (বায়হাকি)
এ সকল দলিলের আলোকে বহু ইমাম ও সালফে সালেহিন ঘোষণা করেছেন ইচ্ছাকৃত নামাজ বর্জন ইসলাম থেকে বিচ্যুতি।
হাদিসে হুঁশিয়ারি
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুআয (রা.)-কে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, কখনোই ইচ্ছাকৃত ফরজ নামাজ ছেড়ে দেবে না। কারণ যে তা করে, আল্লাহ তার ওপর থেকে জিম্মাদারি সরিয়ে নেন। (মুসনাদে আহমদ)
এক মুসলমানের জীবনে এর চেয়ে ভয়াবহ আর কী হতে পারে নামাজ ছেড়ে দেওয়ার রাব্বুল আলামিন তার রহমত, সাহায্য ও সুরক্ষা থেকে তাকে দূরে সরিয়ে নেন!
কোরআনের নামাজ পরিত্যাগের পরিণতি
আল্লাহ বলেন: তারা যদি তওবা করে, সালাত কায়েম করে এবং জাকাত দেয়—তবে তারা তোমাদের ধর্মীয় ভাই। (সুরা তাওবা, আয়াত : ১১)
এ আয়াতের ইঙ্গিত শিরক ত্যাগ করলেও যদি নামাজ কায়েম না করে, তবে মুসলিম সমাজের একজন সদস্য হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্যতাই থাকে না। এ ব্যাখ্যা অধিকাংশ ফুকাহা ও মুফাসসিরগণের নিকট গ্রহণযোগ্য।
আরও বর্ণিত হয়েছে : তাদের পরে এমন কিছু লোক এল যারা নামাজ নষ্ট করল…। তারা ক্ষতির সম্মুখীন হবে। (সুরা মারয়াম, আয়াত : ৫৯)
এ বিশ্লেষণ জানিয়ে দেয়, নামাজ নষ্ট করা ও কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ, এ দুটো একত্র হলে ঈমান বিপদের মুখে পতিত হয়।
জুমার নামাজ আদায়ের যদি সক্ষমতা না থাকে সেই ক্ষেত্রে শরীয়ত ছাড় দিয়েছে, শরিয়তসম্মত ওজর, যেমন অসুস্থতা, ভ্রমণ, ভয় বা অক্ষমতা, এগুলো থাকলে জুমার পরিবর্তে জোহরের অনুমতি আছে। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে জুমা বর্জন, এটি কঠিন গুনাহ এবং নামাজের মর্যাদার প্রতি অবমাননা।
জুমা বর্জনের কাফফারা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি কোনো ওজর ছাড়াই জুমা ছেড়ে দিল, সে যেন এক দীনার সদকা করে; সক্ষম না হলে অর্ধ দীনার সদকা করুক। (আবু দাউদ: ১০৫৩; নাসায়ী; ইবনু মাজাহ)
জুমার নামাজ বর্জন মানে , রহমতের দরজা নিজ হাতে বন্ধ করে দেওয়া, ঈমানের আলো নেভানো, এবং আল্লাহর সুরক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়া।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের অন্তরগুলোকে কোমল ও খাঁটি করে দিন, নামাজকে আমাদের জীবনের শান্তি, সান্ত্বনা ও শক্তির উৎস বানিয়ে দিন। প্রতিটি সিজদা যেন আমাদের হৃদয়ের কঠোরতা দূর করে দেয়, আর প্রতিটি রাকাত আমাদের রবের নৈকট্যে পৌঁছে দেয়।
লেখক : শিক্ষক, মারকাযুস সুন্নাহ মাদরাসা মাতুয়াইল, ডেমরা, ঢাকা
আরও পড়ুন:








