জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন নির্বাচনী জোটে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গড়ে ওঠা তরুণদের এই দলটি পাঁচ দিনের আলোচনার পর রোববার জোটে যোগদানের ঘোষণা দেয়। দলটির ভেতরে একাংশের আপত্তি থাকলেও শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তটি কার্যকর হয়। একই সঙ্গে বিএনপির জোট থেকে বেরিয়ে আসা এলডিপিও নতুন জোটে যুক্ত হয়েছে। এতে জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোটে দলের সংখ্যা দাঁড়াল ১০-এ।
জোটসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে দলগুলোর মধ্যে আসন বণ্টন নিয়ে সমঝোতা হয়েছে। এর আওতায় এনসিপি ৩০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সম্মত হয়েছে। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশকে ৩১টি এবং মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসকে ১৩টি আসন দেওয়া হয়েছে। তবে উভয় দলই এ বণ্টনে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে এবং আরও বেশি আসনে প্রার্থী দেওয়ার দাবি জানিয়েছে।
সূত্র মতে, আসন সমঝোতা না হওয়ায় এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জোটে যোগ দেয়নি এবি পার্টি। দলটিকে তিনটি আসন ছাড় দিতে রাজি হয়েছে জামায়াত, কিন্তু এবি পার্টি অন্তত ১০টি আসন দাবি করছে। এদিকে আসন না পাওয়ায় বিএনপি থেকে আসা লেবার পার্টিসহ কয়েকটি দলকে কোনো আসন ছাড়েনি জামায়াত।
সমঝোতা অনুযায়ী জামায়াত এনসিপির কয়েকজন শীর্ষ নেতার জন্য নির্দিষ্ট আসন ছেড়ে দিয়েছে। এর মধ্যে নাহিদ ইসলামকে ঢাকা-১১, আখতার হোসেনকে রংপুর-৪, সারজিস আলমকে পঞ্চগড়-১, হাসনাত আবদুল্লাহকে কুমিল্লা-৪, নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীকে ঢাকা-৮ এবং আরিফুল ইসলাম আদীবকে ঢাকা-১৮ আসন দেওয়া হয়েছে।
জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির সমঝোতায় দলটির ভেতরে ভাঙনের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। রোববার যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনূভা জাবীন পদত্যাগ করেন। এর আগের দিন দল ছাড়েন ডা. তাসনিম জারা। জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্থা শারমিনসহ আরও কয়েকজন নেতা প্রকাশ্যে ক্ষোভ জানিয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ পদত্যাগ করতে পারেন বলে জানা গেছে।
রোববার বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান জানান, এনসিপি ও এলডিপি তাদের নির্বাচনী সমঝোতার উদ্যোগে যোগ দিয়েছে। এ সময় তাঁর পাশে ছিলেন এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম।
এরপর রাতে রাজধানীর বাংলামটরে সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, জামায়াত ও সমমনা দলগুলোর সঙ্গে এটি আদর্শিক নয়, বরং নির্বাচনী সমঝোতা। যেসব আসনে জামায়াতের ‘শাপলা কলি’ প্রতীকের প্রার্থী থাকবে না, সেখানে এনসিপি সমঝোতাভুক্ত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবে।
এনসিপির সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার বিরোধী অবস্থানে থাকা সামান্থা শারমিন ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য নাহিদ সারোয়ার নিভা উপস্থিত ছিলেন না। উভয় দলই জানিয়েছে, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন, সংস্কার, জুলাই গণহত্যার বিচার, আধিপত্যবাদবিরোধী অবস্থান এবং গণভোটে ‘হ্যাঁ’ ভোটের পক্ষে ঐকমত্যের ভিত্তিতেই এই সমঝোতা হয়েছে।
পুরোনো মিত্রদের অসন্তোষ, জোট ভাঙনের আশঙ্কা
এনসিপি ৩০ আসনে রাজি হলেও জামায়াতের পুরোনো মিত্র ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলাম পার্টি ও খেলাফত মজলিসের একাংশ তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এই পাঁচ দল মিলেই গত মে মাসে একটি মোর্চা গঠন করেছিল, যেখানে পরে জামায়াত যোগ দেয়। পরবর্তীতে জাগপা ও বিডিপিও এতে যুক্ত হয়।
ইসলামী আন্দোলন প্রথমে ১৫০ আসন দাবি করেছিল। পরে প্রস্তাব দেয়, জামায়াত ১৫০ এবং বাকি দলগুলো ১৫০ আসনে নির্বাচন করবে। সর্বশেষ ৭৫ আসনে ছাড়ের দাবি জানালেও শেষ পর্যন্ত তাদের জন্য ৩১টি আসন নির্ধারণ করা হয়।
মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস ৫০ আসন চাইলেও পেয়েছে ১৩টি। খেলাফতের আরেক অংশ ৩০ আসন চেয়ে শেষ পর্যন্ত পাঁচটিতে ছাড় দিয়েছে। নেজামে ইসলাম ও খেলাফত আন্দোলন পেয়েছে দুটি করে আসন। জাগপা ও বিডিপিকে দেওয়া হয়েছে একটি করে আসন।
প্রেস ক্লাবের সংবাদ সম্মেলনের পর পুরানা পল্টনে ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিসের নেতারা বৈঠক করেন। সিদ্ধান্ত হয়, নির্ধারিত ছাড়ের বাইরে আজ সোমবার শেষ দিনে তারা অতিরিক্ত আসনেও মনোনয়নপত্র জমা দেবেন। ইসলামী আন্দোলন শতাধিক এবং খেলাফত মজলিস প্রায় ৫০ আসনে মনোনয়ন জমা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
২০ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সুযোগ থাকায় ওই সময়ের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা চলবে। সমঝোতা না হলে জোট টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে বলে দলগুলোর নেতারা জানিয়েছেন।
সাবেক উপদেষ্টাদের নিয়ে এনসিপির চাপ, জামায়াতের আপত্তি
অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে জোটের প্রার্থী করা হবে না—এই সিদ্ধান্ত জামায়াত আগেই জানিয়েছে। এনসিপির দাবির মুখে আসিফকে বিবেচনার আশ্বাস দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত জামায়াত জানিয়ে দেয়, দুই সাবেক উপদেষ্টার কাউকেই জোটের প্রার্থী করা হবে না।
মাহফুজ আলম ফেসবুকে জানান, তিনি এনসিপিতে যোগ দিচ্ছেন না এবং জোটের পক্ষ থেকেও তাঁকে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অবস্থান ধরে রাখাই তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে আসিফ মাহমুদ ঢাকা-১০ আসন থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। এনসিপির পক্ষ থেকে তাঁকে প্রার্থী করার চেষ্টা চললেও তিনি দলীয় না স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করবেন, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
অপেক্ষায় এবি পার্টি
এনসিপির গণতান্ত্রিক সংস্কার জোটের শরিক এবি পার্টি গত বুধবার থেকে জামায়াতের সঙ্গে আলোচনায় রয়েছে। তিনটি আসনের প্রস্তাবে তারা সন্তুষ্ট নয় এবং ১০টি আসন দাবি করছে। এ কারণে তারা জামায়াতের সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেয়নি। দলটির নেতারা জানিয়েছেন, প্রত্যাহারের আগে সমঝোতা হলে তারা জোটে যুক্ত হতে পারে, তবে এর জন্য ন্যূনতম কর্মসূচিতে ঐকমত্য প্রয়োজন।
নাহিদের ব্যাখ্যা
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, প্রাথমিকভাবে ৩০০ আসনে এককভাবে নির্বাচন করার পরিকল্পনা থাকলেও সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় বৃহত্তর ঐক্যের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আধিপত্যবাদী শক্তির মোকাবিলা, সংস্কার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতেই এই সমঝোতা।
তিনি জানান, এটি আদর্শিক ঐক্য নয়, বরং ন্যূনতম কর্মসূচিভিত্তিক নির্বাচনী সমঝোতা। এনসিপি তার নিজস্ব লক্ষ্য ও আদর্শ অনুযায়ী রাজনীতি চালিয়ে যাবে।
আরও পড়ুন:








