‘স্বনির্ভর অর্থনীতি ও সুশাসনে সমৃদ্ধি’ স্লোগানটি তারেক রহমানের আম জনতার দলের। স্লোগানের প্রথম শব্দের সঙ্গে দলটির কোনো মিল লক্ষ্য করা যায়নি। কেননা, স্বনির্ভর অর্থনীতির কথা বললেও এই দলটির নেতা তারেক প্রতিনিয়তই দল পরিচালনা করতে তার ফেসবুকের মাধ্যমে বিকাশে টাকা চেয়ে থাকেন সাধারণ মানুষের কাছে।
শুধু এসবেই থেমে নেই বিতর্কিত এই তথাকথিত নেতা। সব সময় যেন নিজেকে আলোচনায় রাখতে পছন্দ করেন তারেক রহমান। সব শেষ, তার দলের নিবন্ধন নিতে ইসির সামনে অনশনে বসেছিলেন তিনি। তবে, সেটি ছিল নামমাত্র অনশন এবং সম্পূর্ণ নাটক। ইসির নিবন্ধন পেতেই এমন নাটক করেছেন বলছেন অনেকেই।
তবে, এসব বিষয়ে একটা জিনিস পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের রাজনীতি মঞ্চনাটকের মতো। হঠাৎ বিচিত্র সব ইস্যু এসে জনসাধারণের মনোযোগ কেড়ে নেয়। যেমন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতির গরম হাওয়ার মধ্যেই মিডিয়ায় জায়গা করে নিয়েছে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের দাবিতে অনশনের ইস্যু। অনশনে কি নিবন্ধনও মেলে?
টানা ১২৫ ঘণ্টা নাটকের পর নিবন্ধন পেয়েছে তারেকের আম জনতার দল। সঙ্গে দেওয়া হয়েছে জনতার দল নামের আরেক দলের নিবন্ধনও। এ যেন, অনশন করলেই মেলে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন।
অভিযোগ রয়েছে, বিধি ভেঙে আম জনতা ও জনতার দলের নিবন্ধন দিয়েছে ইসি। শনিবার অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্টের এক সংবাদে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আবেদন চূড়ান্তভাবে নামঞ্জুর করার পরও সাতটি দলের আবেদন পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে আইন এবং বিধিমালার যথাযথ প্রয়োগ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
অনলাইন পত্রিকাটি আইন বিশেষজ্ঞদের বরাতে দিয়ে বলছে, কমিশন ‘ইনহেরেন্ট পাওয়ার’ প্রয়োগ করলেও এটি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিও ও রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
এরপর, বিষয়টি নজরে আনলে ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন, কমিশন তাদের সহজাত ক্ষমতা বা ইনহেরেন্ট পাওয়ার প্রয়োগ করছে। তবে, আরপিও’র বাইরে গিয়ে নির্বাচন কমিশনের সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই বলে নির্বাচন ব্যবস্থা ও আইন বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন।
এর আগে, ‘আম জনতার দলের সদস্য সচিব তারেক রহমানের দল নিবন্ধনের আবেদন নামঞ্জুর করায় তিনি নির্বাচন কমিশন ভবনের সামনে আমরণ অনশনে বসেন। দল নিবন্ধন না পাওয়ার প্রতিবাদে ইসির সামনে চলমান অনশনে বিভিন্ন মহলের ব্যক্তিরা একাত্মতা প্রকাশ করেন। সর্বশেষ বিএনপি তারেক রহমানের প্রতি সমর্থন জানালে নির্বাচন কমিশন ‘আম জনতার দল’-সহ মোট সাতটি দলের নিবন্ধন আবেদন পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নেয়।
এদিকে, আইন বলছে নতুন দলের নিবন্ধন নিতে হলে মানতে হবে বিধিমালা। নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নামঞ্জুর বিষয়ে বিধিমালায় রয়েছে, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন সংক্রান্ত বিধিমালার বিধি ৪-এর অধীনে কোনো আবেদন পাওয়ার পর নির্বাচন কমিশন আবেদনপত্র, তাতে উল্লেখিত তথ্য এবং বিধি ৬ অনুযায়ী সংযুক্ত দলিলাদির সঠিকতা যাচাই করবে। একই সঙ্গে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের আর্টিকেল ৯০ই অনুযায়ী নিবন্ধনের শর্তাবলি পূরণ করা হয়েছে কি না, তাও পরীক্ষা করবে।
আবার, ৫-এর উপ-বিধি (১)-এর অধীন যাচাই শেষে কমিশনের কাছে যদি প্রতীয়মান হয় যে— (ক) নিবন্ধনের আবেদন যথাযথভাবে পূরণ করা হয়নি; অথবা (খ) আর্টিকেল ৯০ই অনুযায়ী নিবন্ধনের শর্তাবলি পূরণ করা হয়নি; অথবা (গ) বিধি ৬-এ উল্লিখিত প্রয়োজনীয় দলিলাদি আবেদনপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়নি, তাহলে কমিশন আবেদনকারী দলকে অনূর্ধ্ব ১৫ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় দলিলাদি সরবরাহসহ অন্যান্য ত্রুটি সংশোধনের সুযোগ দিয়ে লিখিতভাবে অবহিত করবে।
ওই পত্র পাওয়ার পর আবেদনকারী দল নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করলে কমিশন বিধি ৪-এর উপ-বিধি (২), (৩) ও (৪)-এ বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণ করে আবেদনটি মঞ্জুর বা নামঞ্জুর করতে পারবে। অন্যদিকে, ৭-এর উপ-বিধি (৫)-এ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদনকারী দল কোনো পদক্ষেপ না নিলে কমিশন সংশ্লিষ্ট দলকে নিবন্ধনের অযোগ্য বিবেচনা করে আবেদনটি চূড়ান্তভাবে নামঞ্জুর করবে।
নামঞ্জুরের পর পুনর্বিবেচনা ও আরপিওতে বলা আছে, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন নামঞ্জুরের বিষয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিও স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে। আরপিওর ৯০-ঙ (২) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের আবেদন নাকচ করা হলে সাত কার্যদিবসের মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট দলকে তা অবহিত করতে হবে। আরপিও অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন ‘আম জনতার দল’-সহ যেসব দলের নিবন্ধন আবেদন নামঞ্জুর করেছে, সেসব দলকে সাত কার্যদিবসের মধ্যেই নিবন্ধন না পাওয়ার বিস্তারিত কারণ লিখিতভাবে জানিয়ে দেয়। তবে, পত্রিকাটি আইনজ্ঞদের বরাতে দিয়ে বলছে, চূড়ান্তভাবে নামঞ্জুরের সিদ্ধান্ত জানানোর পরও আরপিও বহির্ভূতভাবে সাতটি দলের আবেদন পুনর্বিবেচনা করেছে নাসির উদ্দিন কমিশন। অতীতে কোনো দলের নিবন্ধন আবেদন নামঞ্জুর হলে সংশ্লিষ্ট দল সরাসরি আদালতের দ্বারস্থ হতো। কিন্তু এবার কমিশন আইন বহির্ভূতভাবে পুনরায় যাচাই-বাছাই করে আম জনতার দল ও জনতার দলকে নিবন্ধন দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে, যা নিয়মবহির্ভূত।
এর আগে, এই দুই দলকে নিবন্ধন না পাওয়ার বিষয়ে চিঠি দেয় ইসি। নিবন্ধন নামঞ্জুরের বিষয়ে ইসির পাঠানো ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ এবং রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা ২০০৮-এর শর্তাবলি যথাযথভাবে পূরণ না করায় ‘আম জনতার দলের’ নিবন্ধনের আবেদন নামঞ্জুর করা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, ‘আম জনতার দলের’ ২০ এপ্রিলের নিবন্ধন আবেদনটি আরপিও, ১৯৭২-এর ৯০-খ (১) (ক) (ই) ধারার আলোকে যাচাই করা হয়েছে।
নিবন্ধন না পাওয়ার বিষয়ে ইসি জানায়, প্রাথমিক যাচাইয়ে দলটির আবেদনে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিও এবং রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা, ২০০৮-এর একাধিক শর্ত পালনে ঘাটতি পাওয়া গেছে। ইসির মতে, আরপিওর ৯০-খ (১) (ক) (ই) ধারার শর্তাবলি যথাযথভাবে পালন করেনি দলটি। প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর জেলা দপ্তরের জন্য বাড়িভাড়ার রসিদ, চুক্তিপত্র বা মালিকানা সংক্রান্ত দলিল সংযুক্ত করেনি তারা। একইভাবে প্রয়োজনীয় ১০০টি উপজেলা/থানায় কমিটির তালিকা এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বাড়িভাড়ার রসিদ, চুক্তিপত্র বা মালিকানার দলিলও দাখিল করেনি।
আবার, দলের নামে ব্যাংক হিসাবসংক্রান্ত তথ্য ও তহবিলের উৎসের বিবরণ জমা দেওয়া হয়নি। নিবন্ধনের আবেদন দাখিলের জন্য দল কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতাপত্র সংযুক্ত করা হয়নি। গঠনতন্ত্রে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্যপদ সংরক্ষণের বিধান রাখা হয়নি। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, পেশাজীবী ও শ্রমিকদের সমন্বয়ে কোনো সহযোগী বা অঙ্গ সংগঠন না থাকার বিধানও গঠনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এছাড়া, দলটি সংবিধান পরিপন্থী কোনো কার্যক্রমে জড়িত নয় এবং দলে দণ্ডপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি নেই— এ মর্মে দলের প্রধানের ইস্যুকৃত প্রত্যয়নপত্রও দাখিল করা হয়নি।
এত ত্রুটি থাকার পরও নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে তারেক রহমানের আম জনতার দলকে। অন্যদিকে, সব কিছু ঠিকঠাক থাকলেও এবং ইসির যাচাই-বাছাইয়ে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হলেও বাংলাদেশ আম জনগণ পার্টির নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় আটকে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
ইসির মনগড়া এমন সিদ্ধান্তে নানা মহলে তৈরি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অনেকেই বলছে, কোনো এক অজানা চাপে আম জনতার দলকে নিবন্ধন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন বা ইসি।
আরও পড়ুন:








