“আট দলের বিজয় চাই না, আমার বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের বিজয় চাই। আমরা দুর্নীতিমুক্ত সমাজ, ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা; তাবেদারি নয়—স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যেতে চাই”— কথাগুলো বলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আমীর ডা. শফিকুর রহমান।
সোমবার (১ ডিসেম্বর) বিকেলে আন্দোলনরত ৮ দল খুলনা আয়োজিত নগরীর ঐতিহাসিক বাবরী চত্বর (শিববাড়ী মোড়) খুলনা বিভাগীয় সমাবেশে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর পীর সাহেব চরমোনাই মুফতি সৈয়দ মো. রেজাউল করিম এর সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন— বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর আল্লামা মামুনুল হক, খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মুফতি মুসা বিন ইজহার, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউসুফ সাদেক হক্কানী, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি–জাগপার সহ-সভাপতি ও মুখপাত্র ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ প্রধান, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি)–এর চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম চাঁন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুল আউয়াল ও মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমাদ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি ড. হামিদুর রহমান আজাদ, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি–জাগপার সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ইকবাল হোসেন এবং খেলাফত মজলিস কেন্দ্রীয় সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর হোসাইন।
দুপুর ১২টায় অর্থসহ পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে সমাবেশ শুরু হয়। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য ও খুলনা মহানগরী সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট শেখ জাহাঙ্গীর হুসাইন হেলাল এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহানগর সহ-সভাপতি শেখ মো. নাসির উদ্দিনের পরিচালনায় এ বিভাগীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
জামায়াতের আমীর বলেন, “৫ আগস্ট বিপ্লবের পরদিন থেকে একটি গোষ্ঠী প্রভাব বিস্তারের জন্য জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, অরাজকতা অব্যাহত আছে। ক্ষমতায় না গিয়েও অনেকে ক্ষমতার দাপট দেখাচ্ছে; প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে। মানুষ বলতে বাধ্য হচ্ছে— আগে ভালো ছিলাম না, এখন আরও খারাপ আছি। তবে এ সময়ে কোনো ইসলামী দলের গায়ে চাঁদাবাজের তকমা লাগেনি”— দাবি করেন তিনি।
৩৫ বছর বা তার নিচে যাদের বয়স এবং যারা বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি, তাদের উদ্দেশে জামায়াতের আমীর বলেন, “এবার তোমাদের ভোট নিয়ে কেউ ছিনিমিনি করতে চাইলে আমরা তা হতে দেব না। সেদিন আমারও যুবক হয়ে তোমাদের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করব।”
তরুণ ভোটারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “তোমাদের হাতে আমার দেশটা তুলে দিতে চাই। সেজন্য নিজেদের প্রস্তুত করো। তোমরা চাকরি করবে না, চাকরি দেবে।”
তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫৪ বছরে জনগণের লালিত স্বপ্ন অনেকাংশেই বাস্তবায়ন হয়নি। দৃশ্যমান কিছু উন্নয়ন হলেও সেটি প্রকৃত উন্নয়ন নয়। দেশ ও জাতির মধ্যে ন্যায়বিচার ও সামাজিক সুশাসন আছে কি না— সেটাই বিবেচ্য।
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা দুই ধারায় চলমান উল্লেখ করে জামায়াতের আমীর বলেন, “এক ধারায় রয়েছে মাদরাসা শিক্ষা, আর অন্য ধারায় স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা। মাদরাসায় খুনখারাবি হয় না, অস্ত্রবাজি হয় না— জ্ঞানের চর্চাই হয়। পক্ষান্তরে ৫৪ বছরে কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানদের লাশ পড়েছে; মদ–গাঁজার আসর বসেছে; মেয়েদের ইজ্জত লুট হয়েছে; অস্ত্রের ঝনঝনানি হয়েছে। সভ্য হতে হলে আমাদের দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে।”
তিনি অভিযোগ করেন, কিছু দল ও ব্যক্তি দফায় দফায় দেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে।
সভাপতির বক্তব্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর পীর সাহেব চরমোনাই মুফতি সৈয়দ মো. রেজাউল করিম বলেন, “অনেকে বলেন আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত নই; কিন্তু আমরা নির্বাচনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। বরং তারাই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে হিসাব–নিকাশ করে দেখেছেন তাদের পায়ের তলায় মাটি সরে গেছে। এবার নির্বাচন নিয়ে আপনারাই ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন। গুন্ডামি করে, সেন্টার দখল করে, সন্ত্রাসী চালিয়ে ক্ষমতার চেয়ারে বসবেন— সেদিন ভুলে যান। সে সুযোগ আর পাবেন না।”
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর আল্লামা মামুনুল হক বলেন, “জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশ আজ দুই ভাগে বিভক্ত— ’৭২-এর বাকশালপন্থি আর ২০২৪ সালের বিপ্লবপন্থি শক্তি। রক্তের সাগর পেরিয়ে ২৪-এর জুলাই বিপ্লবে যেই ফ্যাসিবাদ বিতাড়িত হয়েছে, তা আর বাংলার মাটিতে আসবে না। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি কার্যকরে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম। জুলাই সনদকে চূড়ান্ত আইনি ভিত্তি দিতে গণভোটের আয়োজন করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “ইন্টারিম সরকার ব্যর্থ হলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না। দলীয় প্রতীকে ভোট দেওয়ার পাশাপাশি হ্যাঁ-ভোটের বাক্সও ভরতে হবে।”
তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সুস্থতার জন্য দোয়া প্রার্থনা করেন।
খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন বলেন, “ফ্যাসিস্ট সরকার দেশকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছে। তারা চেয়েছিল ৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে। ৮ দল ক্ষমতায় গেলে চাঁদাবাজ থাকবে না। জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে— ইনশাআল্লাহ এটাকে কেউ ভাঙতে পারবে না।”
বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মুফতি মুসা বিন ইজহার বলেন, “খান জাহান আলীর শহর খুলনা— রূপালী শহর খুলনা। যারা সংস্কারের বিরুদ্ধে থাকবে, আগামী নির্বাচনে জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করবে। যারা এ দেশে শরীয়াহ আইন চায় না, তাদের লাল কার্ড দেখাবে। সিসা ঢালা এই ঐক্য ধরে রেখে আমরা ইসলামী সংসদ গড়ে তুলব।”
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউসুফ সাদেক হক্কানী বলেন, “এই দেশের সংবিধান হবে আল্লাহর কুরআন; সংসদে হবে কুরআনের আইন। যেকোনো ষড়যন্ত্র আমরা মোকাবিলা করব। মানুষকে বোঝাতে হবে— আল্লাহর আইন ছাড়া শান্তি সম্ভব নয়।”
জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি–জাগপার সহ-সভাপতি ও মুখপাত্র ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ প্রধান বলেন, “যারা বলেছিল ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিবকে খুলনায় আসতে দেব না— তারা এসে দেখে যাক বাবরী চত্বর ইসলামী দলে ভরে গেছে। জাতীয় নির্বাচন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে করতে হবে। জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। ৫ আগস্টে জনগণ দেখেছে— এ দেশের মানুষ হিন্দুত্ববাদ কায়েম করতে চায় না, চাঁদাবাজিও দেখতে চায় না। গণভোটের প্রশ্নে তিনি বলেন— গণভোটকে ‘হ্যাঁ’ বলুন, ৮ দলের প্রতীকে সিল মারুন।”
বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি)–এর চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম চাঁন বলেন, “জুলাই মানে অকাতরে সংগ্রাম করে জীবন দিতে হবে না। আমরা দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছি। এ দেশের মানুষ অন্য দেশের দালালি করতে চায় না— মানুষ দালালি নয়, মুক্তি চায়।”
আরও পড়ুন:








