মুন্সীগঞ্জের চরকেওয়ার ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন গাজী—যাকে স্থানীয়রা ‘মোতা গাজী’ নামে চেনে—তার বিরুদ্ধে বহু বছর ধরে দখল, চাঁদাবাজি, মারধর ও হত্যার অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এক বিস্ময়কর ঘটনা। অভিযোগ উঠেছে, বিএনপির কিছু স্থানীয় নেতা মোতা গাজী ও তার সহযোগীদের দখলকৃত জমি বালু ভরাট করে বিক্রিতে সহযোগিতা করছেন।
স্থানীয়রা জানান, নব্বইয়ের দশকে বিএনপির সমর্থনে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন মোতা গাজী। শুরু থেকেই তিনি আশপাশের মানুষের জমি ও পুকুর দখল এবং ভয়-ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন। জেলা বিএনপির তৎকালীন হস্তক্ষেপে একসময় তার প্রভাব কিছুটা কমলেও, পরে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ২০০৮ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের পর তার রাজনৈতিক ও আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন নাটকীয়।
অভিযোগ অনুযায়ী, বিদেশফেরত মানুষদের কাছে চাঁদা দাবি করা হতো; নতুন বাড়ি বা ব্যবসা শুরু করতে গেলে মোতা গাজী ও তার ভাতিজা শ্যামল গাজীর কাছে ১–১.৫ লাখ টাকা দিতে হতো। অস্বীকৃতি জানালে মারধর, কাজ বন্ধ এবং জীবননাশের হুমকি দেওয়া হতো।
হোগলাকান্দির দ্বীন ইসলাম অভিযোগ করেন, “২০১০ সালে আমার বাবাকে হত্যা করেছে মোতা গাজী ও তার ভাতিজা। তখন আওয়ামী লীগ লোকজন মামলা করতে দেয়নি। একসময় তার কিছুই ছিল না, কিন্তু ১৭ বছর ধরে জুলুম-অত্যাচার করে এখন শহরে বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছে। চরকেওয়ার বিএনপি নেতাকর্মীরা তার অত্যাচারে ৭–১০ বছর এলাকায় আসতে পারেনি। এখন কীভাবে বিএনপি নেতা তার জমি বিক্রিতে সহযোগিতা করছে?”
অভিযোগ অনুযায়ী, মোতা গাজীর সম্পদের পরিমাণ বর্তমানে অর্ধ শতকোটিরও বেশি। তার মালিকানাধীন স্থাপনার মধ্যে রয়েছে—আমতলা ‘গাজী ভিলা’, হোগলাকান্দি ব্রিজ সংলগ্ন ১২ শতাংশ জমি, আমতলায় ৩০ শতাংশ জমি, মুন্সীকান্দি প্রবেশপথে ১০০ শতাংশ কৃষিজমি, মুন্সিরহাটে দুটি দোকান, মুন্সীগঞ্জ শহরে দুটি চারতলা ভবন, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় জমি, বহুতল ভবন, দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীরা এই জমি বিক্রিতে সহায়তা করছেন।
মোতা গাজীর বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা, চাঁদাবাজি ও দখলদারির মামলা রয়েছে। ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংঘর্ষ ও ককটেল হামলার ঘটনায় তার নাম উঠে আসে। রিয়াজুল, সজল ও ডিপজল ফরাজী হত্যা মামলার অন্যতম আসামি মোতা গাজী ও তার পরিবারের সদস্যরা।
অভিযোগকারী আরিফ জানান, “অল্প টাকার বিনিময়ে আমার কাছ থেকে একটি বিল্ডিং কিনে নেয় মোতা গাজী। নির্বাচনের আগে রাস্তার পাশে দুই শতাংশ জমি লিখতে চাপ দেয়। রাজি না হওয়ায় মারধর করা হয়। নির্বাচনের পর আমাদের পছন্দের প্রার্থী বিজয়ী হলে আমাকে মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার একটি রুমে নিয়ে হাত-পা বেঁধে মারধর করা হয়, বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে হুমকি দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে জমি লিখে দিতে হয়েছে।”
রাজনৈতিক মহলে তুমুল আলোচনা হচ্ছে—বিএনপির কিছু স্থানীয় নেতা ব্যক্তিগত লাভের আশায় মোতা গাজী ও তার সহযোগীদের জমি বিক্রিতে সক্রিয় সহযোগিতা করছেন। অভিযোগে বলা হয়েছে, চরকেওয়া ও সদর উপজেলার বিএনপি নেতা বাচ্চু দেওয়ান, জাকির দেওয়ান, ফরিদ বেপারি, বিটু বেপারি, আফজাল সরকার ও আদু সরকার মোতা গাজী, ভাতিজা শ্যামল গাজী এবং সাবেক আওয়ামী লীগ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামানের দখলকৃত জমিও বিক্রি করছেন।
নতুন করে আমতলা প্রধান সড়ক মুন্সীকান্দি সংলগ্ন ১০০ শতাংশ ফসলি জমি বালু দিয়ে ভরাট করে বিক্রির চেষ্টা চলছে। স্থানীয় বিএনপি কর্মীরা বলছেন, “যারা আমাদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, আমাদের ভাইদের হত্যা করেছে—তাদেরই আজ আমাদের দলের কিছু নেতা টাকা খেয়ে সহযোগিতা করছে। এটি বিশ্বাসঘাতকতা।”
ঘটনাটি রাজনৈতিক নৈতিকতার প্রশ্ন তোলে এবং তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে গভীর ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন উঠেছে—কোন স্বার্থে বিএনপির কিছু নেতা আওয়ামী লীগের বিতর্কিত নেতাদের ‘রক্ষাকবচ’ হয়ে উঠছেন এবং এই ঘটনার জবাব কে দেবে?
আরও পড়ুন:








