রবিবার

২৫ মে, ২০২৫
১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
২৭ জিলক্বদ, ১৪৪৬

রোডম্যাপের আশ্বাস মেলেনি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৫ মে, ২০২৫ ০৭:১৪

আপডেট: ২৫ মে, ২০২৫ ০৭:১৭

শেয়ার

রোডম্যাপের আশ্বাস মেলেনি
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির প্রতিনিধিদল। গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায়। ছবি : সংগৃহীত
  • অসন্তুষ্ট বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানাল
  • জামায়াত চায় সংস্কার ও নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ
  • হাসিনার আমলের সব নির্বাচন বাতিল চায় এনসিপি

    অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক ফলপ্রসূ হয়নি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দ্রুত রোডম্যাপ দেওয়ার কোনো আশ্বাস মেলেনি তাঁর পক্ষ থেকে। ফলে অসন্তুষ্ট দলটি। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পুরনো কথাই বলেছেন।

    গতকাল শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বৈঠক শুরু হয়ে ঘণ্টাব্যাপী চলে। বিএনপির পর জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক হয়। ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদ নির্বাচন নিয়ে সেনাপ্রধানের বক্তব্য, বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের মতভিন্নতা; সেই সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার ‘পদত্যাগের ভাবনা’—সব কিছু মিলিয়ে দেশের রাজনীতিতে তৈরি হওয়া অস্থিরতার মধ্যে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

    জামায়াত মনে করে, নির্বাচনের রোডম্যাপ দরকার।

    পাশাপাশি সংস্কারেরও রোডম্যাপ চায় দলটি। তবে এনসিপি জুলাই গণহত্যার বিচার, জুলাই সনদ এবং গণপরিষদ ও আইন সভা নির্বাচনের সমন্বিত রোডম্যাপ একত্রে ঘোষণা করার কথা বলেছে।

    বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, এই বৈঠকের কোনো ফলাফল নেই। বড় রাজনৈতিক ঘটনার পর প্রধান উপদেষ্টার কাছে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য আশা করেছিলেন তাঁরা।

    তিনি সেই অর্থে তেমন কোনো কথা বলেননি। শুধু শুনেছেন। নির্বাচনের রোডম্যাপের বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু বলেননি। ফলে নির্বাচনের রোডম্যাপ আসলে ঘোষণা হবে কি না তা স্পষ্ট নয়।

    বৈঠক সূত্র জানায়, বিএনপি রোডম্যাপের দাবি তুললে প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথাই পুনর্ব্যক্ত করেন।

    তখন দলটির একজন নেতা বলেন, সংস্কার ও বিচার দৃশ্যমান হলে তো ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা কিছু জানাননি।

    বৈঠক শেষে এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘রোডম্যাপের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রধান উপদেষ্টা জানাননি। বিএনপির পক্ষে দাবিগুলো উনাকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। তাঁরা হয়তো পরে জানাবেন।’

    আপনারা আলোচনায় সন্তুষ্ট কি না জানতে চাইলে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘এখনই প্রতিক্রিয়া জানানোর দরকার নেই। উনারা প্রেস প্রতিক্রিয়া জানালে আমরা পরে জানাব।’

    বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান আলী রীয়াজ এবং স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন। বিএনপি সজীব ভূঁইয়ার পদত্যাগ দাবি করে আসছে। কিন্তু ওই বৈঠকে তিনি উপস্থিত থাকায় বিরক্তি প্রকাশ করেন দলটির নেতারা।

    বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের আলোচনার মধ্যে আসছে সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন। আমরা বলেছি, একটার সঙ্গে আরেকটার সম্পর্ক নেই। কারণ সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া। আমরা আশা করেছি, এই সরকার সবার সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটা সংস্কার দেবে। সেটা চলমান থাকবে। ভবিষ্যতে জনগণ যদি আমাদের ক্ষমতায় বসায় আমরা চলমানভাবে সংস্কারগুলো বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা নেব।’

    তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দ্রুত রোডম্যাপ প্রণয়নের দাবি আমরা জানিয়েছি। বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে, অন্তর্বর্তী সরকারের মূল দায়িত্ব হচ্ছে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা। যেকোনো অছিলায় নির্বাচন যত বিলম্ব করা হবে, আমরা মনে করি দেশে আবার স্বৈরাচার ফিরে আসার ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। স্বৈরাচার ফিরে এলে এর দায়দায়িত্ব বর্তমান সরকার ও তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর বর্তাবে।’

    খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘বিএনপি কখনোই প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ চায়নি। বরং প্রথম দিন থেকে এই সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে আসছে।’

    সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘দুই ছাত্র উপদেষ্টা এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগের বিষয়টি আমরা লিখিতভাবে প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছি। তাঁদের কর্মকাণ্ডের কারণে সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে আমরা বলেছি।’

    মূলত সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন—এই তিন বিষয়ের ওপর বৈঠকে আলোচনা হয়েছে বলে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। ডিসেম্বরের আগেও নির্বাচন করা সম্ভব, এই আলোচনাও হয়েছে।

    গতকাল রাত পৌনে ৮টায় খন্দকার মোশাররফ হোসেন তাঁর তিন সহকর্মীকে নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ‘যমুনা’য় প্রবেশ করেন। ৮টা ৩৫ মিনিটে বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়বস্তু তুলে ধরেন খন্দকার মোশাররফ।

    প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির প্রতিনিধিদলে স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান এবং আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও ছিলেন।

    জামায়াতও রোডম্যাপ চায়

    নির্বাচন কবে হবে, সেটা স্পষ্ট করা দরকার বলে মনে করেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানও। বৈঠকের পর তিনি বলেছেন, ঘোষিত সময়সীমার মধ্যে জনগণের বড় ধরনের ভোগান্তি ছাড়া একটি স্বস্তিজনক সময়ে নির্বাচন হতে পারে। তিনি বলেন, ‘সবাই এগিয়ে এলে অর্থবহ সংস্কারের মধ্য দিয়ে অর্থবহ নির্বাচন হতে পারে। সবাই সেই দিনের অপেক্ষায়।’

    গতকাল প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাইরে বেরিয়ে জামায়াতের আমির এসব কথা বলেন।

    সমাজে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল, আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা কেটেছে—উল্লেখ করে জামায়াতের আমির বলেন, ‘জামায়াত এর স্থায়ী নিষ্পত্তি চায়। দুটি রোডম্যাপ ঘোষণা করলেই সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যাবে, সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ। এই দুটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।’

    জামায়াতের আমির মনে করেন, সময়টি কখন, সেটির একটি রোডম্যাপ (পথনকশা) দরকার। পাশাপাশি সংস্কারেরও রোডম্যাপ প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগে সংস্কার ও বিচার দৃশ্যমান হতে হবে। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে সেটা জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে না। আবার সব সংস্কার এই সরকার করতে পারবে না। মাত্র পাঁচটি সংস্কারে সরকার হাত দিয়েছে। সেগুলো সন্তোষজনকভাবে নিষ্পত্তি হওয়া উচিত।’

    সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের আমির জানান, তাঁরা কোনো উপদেষ্টার পদত্যাগ চাননি।

    অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট কোনো নির্বাচনের সময়ের কথা বলেননি। তিনি শুনেছেন।’ তাঁর কথা তাঁদের কাছে ইতিবাচক মনে হয়েছে। তবে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘তিনি একটি অর্থবহ নির্বাচন চান।’

    বৈঠকে জামায়াতের আমিরের সঙ্গে ছিলেন দলের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের।

    হাসিনার আমলের সব নির্বাচন বাতিল চায় এনসিপি

    শেখ হাসিনার আমলে হওয়া সব নির্বাচন (জাতীয় ও স্থানীয়) আনুষ্ঠিকভাবে অবৈধ ঘোষণা করতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি আহবান জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

    গতকাল শনিবার রাত সোয়া ১০টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে যমুনার সামনে সাংবাদিকদের এ কথা জানান এনসিপির আহবায়ক মো. নাহিদ ইসলাম।

    নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘বিগত সময়ে শেখ হাসিনা ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে নির্বাচন করেছিলেন, যেখানে মানুষের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। রাতের ভোট ও ডামি প্রার্থীর ভোট হয়েছে।’

    শেখ হাসিনার আমলের নির্বাচনগুলো প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তখন এসব নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছিল উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘সেই নির্বাচনগুলো আবার আদালতে নিয়ে গিয়ে এক ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। সেই বিশৃঙ্খলা এড়াতে সেই আগের নির্বাচনগুলো আইনগতভাবে অবৈধ ঘোষণা যাতে করা হয়।’

    নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ওপর এনসিপি আস্থা রাখতে পারছে না উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘ইসি পুনর্গঠন করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন যাতে দ্রুত আয়োজন করা হয়, তা প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছি আমরা।’

    নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘জুলাই গণহত্যার বিচার, জুলাই সনদ এবং গণপরিষদ ও আইন সভা নির্বাচনের সমন্বিত রোডম্যাপ একত্রে ঘোষণা করতে আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি।’

    প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে এনসিপির চার সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন নাহিদ ইসলাম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন দলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব ও সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা।

    আজ রবিবার প্রধান উপদেষ্টা আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করবেন।

banner close
banner close