বুধবার

১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ ২ পৌষ, ১৪৩২

১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা চুরি করেছে ভারত

মেহেদী হাসান কনক

প্রকাশিত: ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ ০৯:২৪

আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ ০৯:২৭

শেয়ার

১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা চুরি করেছে ভারত
ছবি: সংগৃহীত

একাত্তরে রক্তক্ষয়ী নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের ইতি টেনে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধের অবসানে বিজয় লাভ করে ভারত। এই দিনটির আলাদা তাৎপর্য রয়েছে ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশের ইতিহাসে। ১৯৭১ সালে যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেছিল ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী। ফলে পাকিস্তান সেনার নৃশংস দাপট থেকে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশ। দেশকে রক্ষা করার জন্য চূড়ান্ত আত্মত্যাগ করেছিলেন ভারতীয় সেনা জওয়ানরা ৷ তাঁদের সম্মান জানাতে এই দিনটি উদযাপন করা হয় ভারতে। প্রতিবছর ১৬ ডিসম্বর উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের মানুষের ত্যাগের কথা উল্লেখ না করে এভাবেই সংবাদ প্রচার করে ভারতীয় গণমাধ্যম।

১৯৭১ সালে ভারত পাকিস্তানের নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করেন। তারা আত্মসমর্পণ করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে। শুধুমাত্র আত্মসমর্পণের ঘটনাকে পটভূমি করে ভারতের গণমাধ্যমগুলো পাকিস্তানের বিপরীতে বাংলাদেশের পরিবর্তে ভারতকে বসিয়ে সংবাদ প্রচার করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভারতীয় নির্মাতারা বেশ কয়েকটি সিনেমা নির্মাণ করেছে। যার মধ্যে অন্তত পাঁচটি সিনেমা আলোচিত হয়েছে।

ভারতীয় সিনেমাগুলোতে অতি নগণ্য করে দেখানো হয়েছে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্যপট। স্বল্প পরিমান ওই অংশ বাদ দিলে বোঝার উপায় থাকবে না এটি বাংলাদেশ পাকিস্তানের যুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত সিনেমা। এছাড়াও আলোচিত সিনেমাগুলোর নানা ধারাভাষ্যে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ বিজয়ের গল্প তুলে ধরা হয়েছে।

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত ১৬ ডিসেম্বর সিনেমায় সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ দেখানো না হলেও ঘটনা পরম্পরায় মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন খণ্ড চিত্র দেখানো হয়। ভারতীয় পরিচালক অমৃত সাগর পরিচালিত এই সিনেমায় দেখানো হয়েছে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ৬জন ভারতীয় সেনার পালিয়ে আসার গল্প। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে লড়তে আসা ভারতীয় ৬জন সৈনিক বন্দি হয় পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে। ছয় বছর কারাবন্দি থাকার পর ১৯৭৭ সালে জেল থেকে পালিয়ে স্বদেশে ফেরে তারা।

১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর বঙ্গোপসাগরে রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যায় পাকিস্তানি সাবমেরিন পিএনএস গাজী। গাজীর চেয়ে কম শক্তিসম্পন্ন আইএনএস রাজপুত দিয়ে শক্তিশালী ওই সাবমেরিন ডুবিয়ে দেয় ভারত। যার পুরো কৃতিত্ব ভারতীয় নৌবাহিনীর কর্মকর্তা রণ বিজয় সিং ও অর্জুন ভার্মার দাবি করে নির্মিত সিনেমা ‘দ্য গাজী অ্যাটাক’। বলিউড পরিচালক করণ জোহরের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘ধর্ম প্রোডাকশনের’ ব্যানারে নির্মিত সিনেমাটি।

১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর সাবমেরিন হারানোর ঘটনা নিয়ে নির্মিত সিনেমাটিতে ৭১-এর চার ডিসেম্বর ভারতীয় নৌ বাহিনীর সঙ্গে পাক বাহিনীর নৌ-যুদ্ধ দেখানো হয়। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সাবমেরিন ‘পিএনএস গাজী’ নামের জাহাজটি বঙ্গোপসাগরে ডুবে যায়। জাহাজটি ডুবিয়ে দিয়েছিল গাজীর চেয়ে কম শক্তিশালী ভারতীয় সাবমেরিন ‘আইএনএস রাজপুত’। পিএনএস গাজী ডুবিয়ে দেয়ার কৃতিত্ব তুলে ধরে নির্মাণ করা হয় ওই চলচ্চিত্রটি।

২০১৭ সালে মুক্তি পায় ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধের ঘটনায় নির্মিত সিনেমা ‘বার্থ অব আ নেশন’। সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে একজন ভারতী লেফটেন্যান্ট জেনারেলকে নিয়ে, বাংলাদেশ পাকিস্তানের যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে জ্যাকবের বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনায় এই যুদ্ধের গতিপ্রবাহ অন্যদিকে মোড় নেয়, যা বাংলাদেশের বিজয় অর্জনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে দাবি করা হয় সিনেমাটিতে।

বিশ্ব সিনেমার তালিকা ঘাটলে দেখা যায়, বাংলাদেশ পাকিস্তান যুদ্ধের ওপর পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র যা তৈরি হয়েছে, তার বেশিরভাগই হয়েছে বলিউডে। তবে এসব চলচ্চিত্রগুলোতে বেশিরভাগই ক্ষেত্রেই জমকালোভাবে উঠে এসেছে ১৯৭১ সালে সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয়দের অবদানের গল্পগুলো। সিনেমার অনেক ধারাভাষ্যে ১৯৭১ সালের সংঘটিত যুদ্ধকে সরাসরি পাক-ভারত যুদ্ধ দাবি করা হয়েছে। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে বাঙ্গালীদের অকাতরে প্রান বিলিয়ে দেয়ার ঘটনা আড়াল করে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন করে দেয়ার পুরোপুরি কর্তৃত্ত নিজেদের দাবি করে ভারত।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভারতের কিছু সিনেমা রয়েছে যেসব সিনেমার গল্প বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিশেষ করে ভারতীয় সিনেমা গুন্ডে-তে ভারত-পাকিস্তানের তৃতীয় যুদ্ধের ফসল বাংলাদেশ' ধরনের সংলাপ রয়েছে।

জানা যায় ভারতীয় সিনেমা গুন্ডে’র সংলাপ ও প্রেক্ষাপট নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছিল। প্রতিবাদের পর সিনেমাটি কাল্পনিক ঘটনার প্রেক্ষিতে নির্মিত হয়েছে জানানো হয়েছিলো ভারতের পক্ষ থেকে।

এ ছাড়া, ‘আইয়ারি’ সিনেমার গল্পেও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে বলে প্রতষ্ঠা করে ভারতীয় পরিচালক। সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছিলো।

ভারতীয় সিনেমাগুলোর গল্প এবং ধারাভাষ্য বিশ্লেষণ করলে মনে হয় বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে চাইনি। ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের ফসল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রটি।

প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর ভারতে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিজয় দিবস পালিত হয়। দেশটির রাজধানী নয়াদিল্লিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও সেনাবাহিনীর তিন শাখার প্রধানেরা ইন্ডিয়া গেটের অমর জওয়ান জ্যোতিতে মাল্যদান করে।

ভারতের সংস্কৃতিক অঙ্গনে ১৬ ডিসেম্বর নিয়ে এমন অবস্থান নিয়ে কথা বলেছেন সাবেক কূটনিতিক সাকিব আলি। তিনি এগুলোকে প্রপাগান্ডা হিসাবে বর্ননা করেছেন একই সাথে জানিয়েছেন কেন কীভাবে পাক সেনারা ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল।

১৯৭১ পরবর্তী সময়ে প্রতিবছর ভারত বর্ণাঢ্যভাবে বিজয় দিবস পালন করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নোরেন্দ্র মোদীসহ মন্ত্রী পরিষদের গুরত্বপূর্ণ অনেকের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টেও দেখা যায় বাংলাদেশের নাম উল্লেখ না করে কৌশলে ১৯৭১ সাল পাকিস্তানের বিপক্ষে ভারতের জয় বলেই প্রচার করে।

মোদি তার পোস্টে লিখেছেন, ‘বিজয় দিবসে আমরা আমাদের সেই সাহসী সেনাদের স্মরণ করছি, যাদের সাহসিকতা ও আত্মত্যাগ ১৯৭১ সালে ভারতের এক ঐতিহাসিক বিজয় নিশ্চিত করেছিল। তাদের দৃঢ় মনোবল ও নিঃস্বার্থ সেবা আমাদের দেশকে রক্ষা করেছে এবং আমাদের ইতিহাসে একটি গৌরবান্বিত মুহূর্ত তৈরি করেছে। নরেন্দ্র মোদীর এই অবস্থানের বিষয়টি পরিস্কার করেছেন সাবেক কূটনিতিক সাকিব আলি।

অর্থাৎ এরমধ্যে দিয়ে ভারত প্রমাণ করছে ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছিল পাক-ভারত সেনারা। আবার শেখ মুজিবের দেয়া সাক্ষাৎকারেও বিষয়টি প্রমাণ হয়েছে, তিনিও স্বাধীনতা চাননি।

গণমাধমের এক সাক্ষাৎকারে মুজিব দাবি করেছিলেন মুক্ত নাগরিকের মত বসবাস করার অধিকার চান। তখন সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছিলেন ‘তার মানে কি তিনি স্বাধীনতা চান?’ উত্তরে মুজিব বলেছিলেন, ‘ওই কথার মানে তিনি স্বাধিনতা চান না, তবে তার দাবি পূরণ অনেকভাবেই হতে পারে’। এখানে তিনি মূলত অখন্ড পাকিস্তানেই ক্ষমতার মসনদে বসতে চেয়েছিলেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভারতের কিছু সিনেমা বিতর্কিত হয়েছে, বিশেষত দ্য গাজী অ্যাটাক এবং যশরাজ ফিল্মসের গুন্ডে। কারণ এগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও অবমূল্যায়নের অভিযোগ ছিল, যেখানে 'গুন্ডে'-তে 'ভারত-পাকিস্তানের তৃতীয় যুদ্ধের ফসল বাংলাদেশ' ধরনের সংলাপ ছিল এবং 'দ্য গাজী অ্যাটাক'-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভারত-পাকিস্তানের নৌ-যুদ্ধ হিসেবে দেখানোয় বাংলাদেশে ব্যাপক প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এ ছাড়া, আইয়ারি-র মতো সিনেমাতেও ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ ওঠে, যেখানে দেখানো হয়েছিল যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে এমন বার্তা দেয় বলে সমালোচিত হয়।

বিতর্কের মূল কারণ:

ইতিহাস বিকৃতি: অনেক সময় ভারতীয় সিনেমায় মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এমনভাবে দেখানো হয় যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে উপেক্ষা করে এবং ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অবদানকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়, যা ইতিহাস বিকৃতির শামিল বলে বিবেচিত হয়।

মূল অবমূল্যায়ন: গুন্ডে’র মতো সিনেমায় 'ভারত-পাকিস্তানের তৃতীয় যুদ্ধের ফসল বাংলাদেশ' সংলাপটি বাংলাদেশের জনগণের আত্মত্যাগ ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভারতের একক অবদান হিসেবে উপস্থাপন করে, যা তীব্র সমালোচিত হয়।

নৌ-যুদ্ধের ভুল উপস্থাপন: দ্য গাজী অ্যাটাক-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তানের নৌ-যুদ্ধ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, যা বাংলাদেশের জনগণের ভূমিকার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করে বলে মনে করা হয়।

এই সিনেমাগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাসকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হওয়ায় সমালোচিত হয়েছে এবং এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে।



banner close
banner close