ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের তিনটি প্রধান ভূমিকম্পন বলয়ের একটি হলো মধুপুর ফল্ট, যা টাঙ্গাইলসহ আশপাশের অঞ্চলে উচ্চ ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। সাম্প্রতিক শুক্রবার ও শনিবার দেশে কয়েক দফা ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পর আবারো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে এ ফল্টটি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধুপুর ফল্টে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও ঢাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। স্থানীয়দের দাবি—ভূমিকম্প ঝুঁকি সম্পর্কে এখনো কোনো কার্যকর জনসচেতনতামূলক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
গুরুতর ঝুঁকির কারণ
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও সম্পদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মীর মো. মোজাম্মেল হক জানান, বাংলাদেশের তিনটি প্রধান ভূমিকম্পন বলয়ের একটি মধুপুর ফল্ট, যার ব্যাপ্তি টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও ঢাকার ১ কিলোমিটারের মধ্য পর্যন্ত বিস্তৃত। গত দুই দিনেই ঢাকা ও আশপাশে চার দফা ভূমিকম্প হয়েছে, যা বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা বাড়িয়েছে।
তার মতে, মধুপুর ফল্টে ৬ থেকে সাড়ে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটলে প্রায় ১ কোটি মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। কারণ এই অঞ্চলে জনবসতি ঘন, আর ঢাকার নিকটবর্তী হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ভয়াবহ হতে পারে।
ইতিহাস ও গবেষণার তথ্য
মধুপুর ফল্টে ১৮৮৫ সালে ৭ মাত্রার ওপর একটি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। এরপরও এ অঞ্চলে বেশ কিছু ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে টাঙ্গাইলে ৪.২ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল মধুপুর। ওই সময় গড়াঞ্চলের বোকারবাইদ এলাকায় আধা মাইল দীর্ঘ, তিন থেকে চার ইঞ্চি ব্যাসের এবং ১৫ থেকে ২০ ফুট গভীর ভূ-ফাটল তৈরি হয়েছিল।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের ২০১০ সালের এক গবেষণায় বলা হয়—মধুপুর ফল্টে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৭২ হাজারের বেশি পাকা ভবন ধসে যেতে পারে এবং আংশিক ক্ষতি হতে পারে আরও ৫৬ হাজারের বেশি ভবনের।
২০০৮–২০০৯ সালের আরেক গবেষণায় জানা যায়, বাংলাদেশ সীমান্তে টেকটোনিক প্লেটের সীমানায় ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে শুধু ঢাকা শহরেই ২ লাখ ৩৮ হাজারের বেশি ভবন ধসে পড়তে পারে।
অপরিকল্পিত নগরায়নে ঝুঁকি আরও বাড়ছে
টাঙ্গাইল শহর ও আশপাশে গত কয়েক বছর ধরে পরিকল্পনাবহির্ভূতভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ হয়েছে এবং হচ্ছে। অধিকাংশ ভবনের নকশার অনুমোদন না থাকার অভিযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন—বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে এসব ভবন ধসে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটতে পারে।
প্রফেসর মোজাম্মেল হক বলেন, ময়মনসিংহ অঞ্চলে ১৯৫০ সালের বড় ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তন হয়েছিল। এ ইতিহাস দেখেই বোঝা যায়—টাঙ্গাইল ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল।
স্থানীয়দের উদ্বেগ
মধুপুরের বাসিন্দা ও জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সাবেক সভাপতি অজয় মৃ বলেন, আমাদের সচেতন করতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেই। আমরা মধুপুর ফল্টের ওপরই বসবাস করি—স্বাভাবিকভাবেই শঙ্কিত।
মধুপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জুবায়ের হোসেন জানান, মধুপুর ফল্ট নিয়ে এখনো তেমন প্রস্তুতি নেই। বিষয়টি দুর্যোগ মন্ত্রণালয়কে জানানো হবে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, স্থানীয়দের সচেতন করতে দ্রুতই মহড়া আয়োজন করা হবে।
টাঙ্গাইল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক জানে আলম জানান, টাঙ্গাইলের উত্তরাংশ ‘রেড জোনে’ থাকায় ভূমিকম্প মোকাবিলায় প্রস্তুতি জোরদার করা হচ্ছে। চারটি স্টেশনে অতিরিক্ত সরঞ্জাম রয়েছে এবং কমিউনিটি ভলান্টিয়ারদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, বড় ভূমিকম্পে যদি রাস্তা ডেবে যায়, উদ্ধার তৎপরতায় সমস্যা হবে। তাই বিকল্প পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি।
এছাড়া শহরে ভবন নির্মাণে অনিয়ম ঠেকাতে আরও কঠোর ভূমিকা নেওয়ার কথাও জানান তিনি।
আরও পড়ুন:








