২০২৩ সালে তুরস্ক ও সিরিয়ায় শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে ভূমিকম্পের আগ মুহূর্তে পাখিদের অস্বাভাবিক উড়াউড়ির একটি ভিডিও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। টুইটারে প্রকাশিত ওই ভিডিওটিকে অনেকে ভূমিকম্পের ঠিক আগের দৃশ্য বলে দাবি করেন।
ভিডিওটি কোন সময়ের—তার সঠিক তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে পোস্টের নিচে অনেকে মন্তব্যে জানান, পশুপাখি ও সামুদ্রিক প্রাণী দুর্যোগের পূর্বাভাস পায় বলে দুর্যোগের আগেই অস্বাভাবিক আচরণ করে। ইউএসজিএস-এর তথ্যমতে, প্রাণীর অস্বাভাবিক আচরণকে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস হিসেবে ভাবার ধারণা প্রাচীন গ্রিস থেকেই পাওয়া যায়।
কথিত আছে, খ্রিস্টপূর্ব ৩৭৩ সালে ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্পের কয়েক দিন আগে ইঁদুর, বেজি ও সাপ ওই অঞ্চল ছেড়ে চলে যায়। বিজ্ঞানীরা বলেন, কিছু প্রাণী তড়িৎচুম্বকীয় পরিবর্তন বা বায়ুমণ্ডলীয় চাপের ওঠানামা অনুভব করার সক্ষমতা রাখে এবং মাটির কাছাকাছি বসবাসকারী প্রজাতি মাটির সূক্ষ্ম নড়াচড়া আগেভাগে টের পায়। মানুষ কম্পন বুঝতে পারার আগেই যে মৃদু কম্পন সৃষ্টি হয়, তা কুকুরের মতো কিছু প্রাণী শনাক্ত করতে পারে। এরপরও ইউএসজিএস স্পষ্ট করে জানিয়েছে—প্রাণীরা সত্যিই ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে পারে—এমন দাবি বৈজ্ঞানিকভাবে এখনো নিশ্চিত নয়।
২০১৩ সালে জার্মান মহাকাশ গবেষণা সংস্থা রুশ মহাকাশ সংস্থার সহযোগিতায় আইকারাস নামে একটি আন্তর্জাতিক প্রকল্প চালু করে। এর উদ্দেশ্য ছিল উড়ন্ত প্রাণীর অভিবাসন পথ বিশ্লেষণের পাশাপাশি তাদের অস্বাভাবিক আচরণ পর্যবেক্ষণ করে ভূমিকম্প পূর্বাভাসের সম্ভাবনা যাচাই করা। এই উদ্যোগে এক হাজারের মতো পাখি ও বাদুড়ের শরীরে হালকা ট্র্যাকিং ট্যাগ বসানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। যন্ত্রগুলো আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের সাথে রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে সংযুক্ত থেকে প্রাণীর গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য পাঠায়।
প্রকল্পের প্রধান গবেষক অধ্যাপক মার্টিন উইকেলস্কি প্রথমবারের মতো প্রাণীকে ‘ইন্টেলিজেন্ট সেন্সর’ হিসেবে ব্যবহার করে ভূমিকম্প শনাক্তের চেষ্টা করেন। বিজ্ঞানীদের ধারণা—পাখি ও বাদুড় পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র অনুভব করতে পারে। ফলে ভূমিকম্পের আগে চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন তাদের আচরণে প্রতিফলিত হতে পারে।
পশুপাখির আচরণ থেকে দুর্যোগের পূর্বাভাস পাওয়ার উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক উদাহরণের একটি হলো চীনের হাইচেং শহর। সেখানে ১৯৭৫ সালের ৭.৩ মাত্রার ভূমিকম্পের কয়েক সপ্তাহ আগে প্রচণ্ড ঠান্ডার মাঝেও অনেক সাপ গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এ আচরণের ভিত্তিতে শহর খালি করেছিল, ফলে অনেক মানুষের জীবন রক্ষা পায়।
সাম্প্রতিক গবেষণায় ইতালির উত্তরাঞ্চলের ভূমিকম্পপ্রবণ এক খামারে বায়োলগার ও জিপিএস সেন্সর ব্যবহার করে ছয়টি গরু, পাঁচটি ভেড়া এবং দুটি কুকুরের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়। চার মাসে ১৮ হাজারের বেশি কম্পন রেকর্ডের পাশাপাশি প্রাণীর গতিবিধি প্রতি সেকেন্ডে ৪৮ বার রেকর্ড করা হয়।
বিজ্ঞানীদের ধারণা—ভূমিকম্পের আগে মাটি থেকে খনিজজাত আয়ন নিঃসৃত হয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রাণীরা এ পরিবর্তন বুঝতে পেরে অস্বাভাবিক আচরণ করে। ২০১০ সালের গবেষণায়ও দেখা গেছে, শিলা ভাঙার ফলে আয়ন নির্গমন ঘটলে প্রাণীরা পরিবেশগত সংকেত উপলব্ধি করে আচরণে পরিবর্তন আনে এবং প্রজাতিগুলোর মধ্যে এসব সংকেত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ বারবার ইঙ্গিত দেয়—ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে প্রাণীদের আচরণে পরিবর্তন ঘটে। এরপরও বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। তবে এ বিষয়ে গবেষণা চলছে। গবেষকেরা মনে করেন, প্রাণীর আচরণ বিশ্লেষণ ভবিষ্যতে ভূমিকম্প পূর্বাভাসে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
আরও পড়ুন:








