শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটের এই কম্পনে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১০ জন। এর মধ্যে ঢাকায় তিনজন, নারায়ণগঞ্জে একজন, গাজীপুরে একজন এবং ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদীতে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে ছয় শতাধিক মানুষ। ঘটনার পর শোকবার্তা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তিনি সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র জানিয়েছে, ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭। কেন্দ্র ছিল নরসিংদীর মাধবদীতে, ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার গভীরে। ভূমিকম্পের স্থায়িত্ব প্রায় ২৬ সেকেন্ড।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসজিএস বলছে, মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫ এবং উপকেন্দ্র নরসিংদীর পশ্চিম-দক্ষিণপশ্চিমে।
মাত্রার পার্থক্য থাকলেও ধাক্কাটা ছিল প্রবল। পুরান ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম– অল্প সময়েই ছড়িয়ে পড়ে ক্ষয়ক্ষতির খবর। ভূমিকম্পের সময় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে লোকজন বাসা থেকে বের হয়ে আসে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, প্রায় ১০০ বছরের মধ্যে দেশে বড় ভূমিকম্প হয়নি। কিন্তু আমাদের দেশে বড় ভূমিকম্প হওয়ার ইতিহাস রয়েছে। সেদিক থেকে এই ভূমিকম্পটিকে ‘ফোরশক’ বলা যায়। অর্থাৎ একটি বড় ভূমিকম্প আসার আগে যে ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়, এটি তার মধ্যে একটি।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান রুবাইয়াত কবির বলেন, ২০০৭ সাল থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ শুরুর পর থেকে ঢাকার আশপাশে এটাই সর্বোচ্চ মাত্রার। একটা বড় ভূমিকম্প হলে সাধারণত আফটারশক হয়। অর্থাৎ এখানে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। এর চেয়ে কিছুটা কম মাত্রার আরেকটি কম্পন অনুভূত হবে। তবে অতীত ইতিহাস থেকে দেখা যায়, এই অঞ্চলে আফটারশক আমরা তুলনামূলকভাবে কম পেয়েছি।
সারাদেশে মৃত্যু ১০
ভূমিকম্পে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত ১০ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর মধ্যে বংশালের কসাইটুলী এলাকায় তিন পথচারী, রাজধানীর মুগদায় এক নিরাপত্তাকর্মী, রূপগঞ্জে এক শিশু, নরসিংদীতে এক শিশুসহ পাঁচজন মারা গেছেন। এদিকে সরকারি হিসাবে, ভূমিকম্পে আহত হয়েছে ছয় শতাধিক মানুষ। তারা দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় দুইশ জন ভর্তি হয়েছেন। তবে সব মিলিয়ে ভূমিকম্পে আহত হয়েছেন সহস্রাধিক।
নিহতদের মধ্যে রাজধানীর বংশালের কসাইটুলী এলাকায় একটি পাঁচতলা ভবনের রেলিং ভেঙে নিচে পড়ে তিন পথচারী নিহত হয়েছেন। তারা হলেন– আব্দুল রহিম (৪৭) ও তার ছেলে মেহরাব হোসেন রিমন (১৩)। একই ঘটনায় মায়ের সঙ্গে মাংস কিনতে গিয়ে নিহত হয়েছেন সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ৫২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রাফি। তার মা নুসরাত গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন।
এ ছাড়া মুগদার মদিনাবাগ এলাকায় ভূমিকম্পের সময় নির্মাণাধীন ভবনের রেলিং ধসে পড়ে মাকসুদ (৫০) নামে এক নিরাপত্তাকর্মী মারা গেছেন।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ভূমিকম্পে দেয়াল ধসে ফাতেমা নামে ১০ মাসের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। উপজেলার গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের ইসলামবাগ ৫ নম্বর ক্যানেল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় শিশুর মা গুরুতর আহত হয়েছেন। তিনি ঢাকায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এ ছাড়া ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদী সদর, পলাশ ও শিবপুর উপজেলায় পাঁচজন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে সদর উপজেলায় ছাদ ধসে বাবা-ছেলে প্রাণ হারান।
মৃত ব্যক্তিরা হলেন নরসিংদী সদর উপজেলার চিনিশপুর ইউনিয়নের গাবতলী এলাকার মো. দেলোয়ার হোসেন (৩৭) ও তাঁর ছেলে মো. ওমর ফারুক (৯), পলাশের ডাঙ্গা ইউনিয়নের কাজীরচর গ্রামের নয়াপাড়া এলাকার নাসির উদ্দীন (৬৫) ও চরসিন্দুর ইউনিয়নের মালিতা গ্রামের পশ্চিমপাড়া এলাকার কাজম আলী ভূঁইয়া (৭৫) এবং শিবপুর উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের আজকিতলা গ্রামের ফোরকান মিয়া (৩৫)।
সারাদেশে ক্ষয়ক্ষতি
ঢাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৪টি ভবন। নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও জিঞ্জিরায় ছয়টি বহুতল ভবন হেলে পড়েছে। নরসিংদীর পলাশে শীতলক্ষ্যার পুরোনো রেলসেতুতেও ফাটল ধরা পড়েছে। ভূমিকম্পের ধকল সামলাতে পারেনি ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। নরসিংদীর পলাশে কেন্দ্রটির একাংশে আগুন ধরে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জে পড়ে যাওয়া ট্রান্সফরমার ও শর্টসার্কিটে দুটি কারখানায় আগুন লাগে, আহত হন অন্তত তিনজন। ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে কুমিল্লা ইপিজেড, মাগুরার শ্রীপুর ও আদমজী ইপিজেডে দুই শতাধিক শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে গাজীপুর ও কুমিল্লায় সাড়ে ৪ শতাধিক শ্রমিক কমবেশি আহত হন।
ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি পাঁচজন নিহত ও শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে নরসিংদীতে। ফাটল দেখা দিয়েছে একাধিক ভবনে, ধসে গেছে কাঁচা ঘর। পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের সাব-স্টেশনে ভূমিকম্পের সময় অগ্নিকাণ্ডে যন্ত্রাংশ পুড়ে যায়। এ ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়েকটি ভবনে ফাটলেরও সৃষ্টি হয়েছে। শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর পুরোনো রেল সেতুতে ফাটল দেখা দিয়েছে।
কেরানীগঞ্জ
ভূমিকম্পে জিনজিরা বাজার এলাকায় একটি সাততলা ভবন আরেকটি সাততলা ভবনের ওপর হেলে পড়ে। আতঙ্কে দুই ভবনের ভাড়াটিয়ারা বাড়ির নিচে অবস্থান নেয়। এ সময় হুড়োহুড়িতে কয়েকজন সামান্য আহত হয়। প্রথম ভবনটির মালিক স্থানীয় আব্দুর সাত্তার মিয়া। দ্বিতীয় ভবনটি মৌলভীবাজারের ভুট্টো মিয়ার।
কুমিল্লা
ভূমিকম্পের সময় কুমিল্লা ইপিজেডের একটি কারখানায় কর্মরত অন্তত ৮০ নারী শ্রমিক ভয়ে জ্ঞান হারান। পাঁচজন দৌড়ে বের হতে গিয়ে আহত হয়েছেন। তাদের ৫০ জনকে ইপিজেডের ভেতর বেপজা মেডিকেল সেন্টারে ও কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩০ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
গাজীপুরে ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে কারখানা ভবন থেকে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে অন্তত ২৩৮ শ্রমিক আহত হয়েছেন। এর মধ্যে শ্রীপুর পৌরসভার কেওয়া পূর্বখণ্ড গারোপাড়া এলাকার ডেনিমেক নামে একটি পোশাক কারখানায় হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে অন্তত ১৫৬ শ্রমিক আহত হন। এ ছাড়া বহু শ্রমিক আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ ছাড়া ভূমিকম্পের সময় গাজীপুর মহানগরের বাসন থানার হাসান তানভীর ফ্যাশন, ডে ফ্যাশন, কোস্ট টু কোস্ট, কোজিমা লিরিক ও লিবাস টেক্সটাইল লিমিডেট কারখানায় তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে অন্তত ৮২ জন আহত হন।
ভূমিকম্পে কালীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মসজিদ-মাদ্রাসা-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফাটল, মাটির ঘর ধস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে।
নারায়ণগঞ্জ ও সোনারগাঁ শহরের মিশনপাড়ার সিগনেচার এস আহমেদ প্যালেস নামে একটি ৯ তলা ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। বন্দর উপজেলার কুড়িপাড়া এলাকায় ভূমিকম্পে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার পাশের একটি তুলার কারখানার গিয়ে পড়লে সেখানে আগুন লেগে যায়। আগুন নিভাতে গিয়ে তিনজন আহত হয়েছে। সিদ্ধিরগঞ্জ, ভূঁইগড়, ফতুল্লার বিভিন্ন স্থানে ভবনে ফাটলের খবর পাওয়া গেছে। বন্দর উপজেলার কুড়িপাড়া এলাকার জসিম নামের এক ব্যক্তির ঝুটের গোডাউনে ভূমিকম্পের সময় শর্টসার্কিট থেকে আগুন লেগে যায়। পরে এলাকাবাসী আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
সোনারগাঁয়ে পিরোজপুর ইউনিয়ন পরিষদের পাশে দ্বীন ইসলামের প্লাস্টিক গোডাউনে ভূমিকম্পের সময় শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এ সময় গোডাউনের প্রায় সব মালপত্র পুড়ে যায়। এ ছাড়া আতঙ্কে মারুফ হোসেন নামে এক শিক্ষার্থী মাদ্রাসার দ্বিতীয় তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হন।
চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার ডিটি রোডের মনসুরাবাদ পুলিশ লাইন্সের বিপরীতে ভূমিকম্পে সাততলা একটি ভবন হেলে পড়েছে। তবে ভবনটি আগে থেকে হেলানো ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস। ভূমিকম্পে হেলে পড়ার মাত্রা বেড়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের। ভবনটি সাবেক মেয়র মনজুর আলমের মালিকানাধীন।
মুন্সীগঞ্জ শহরের পাঁচঘড়িয়াকান্দি, পূর্ব সরদারপাড়া ও উত্তর ইসলামপুর এলাকার তিনটি ভবনের দেয়ালে ফাটল ও মেঝের টাইলস খসে পড়ে বলে জানা গেছে।
ভূমিকম্পে বাড়ির দেয়াল ধসে তামান্না বিশ্বাস নামে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়েছেন। তাকে প্রথমে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
ভূমিকম্পের পরপরই বরিশালের বানারীপাড়ার উত্তর নাজিরপুর গ্রামে একটি বসতবাড়ি সন্ধ্যা নদীতে সম্পূর্ণ বিলিন হয়ে গেছে। স্থানীয়রা জানান, আগে থেকেই সেখানে নদী ভাঙছিল। তবে ভূমিকম্পের পর হঠাৎ করেই জমির বিরাট অংশে ফাটল দেখা দেয়। পরে তা নদীতে চলে যায়।
আরও পড়ুন:








