রাজধানীর হাইকোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠের পাশে দুটি ড্রামে ভর্তি খণ্ডিত মৃতদেহ উদ্ধারের ঘটনায় মূল আসামি গ্রেফতারসহ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির নাম: মোহাম্মদ জরেজুল ইসলাম (৩৯)।
ডিবি সূত্রে জানা যায়, নিহত আশরাফুল হক (৪৪) দিনাজপুরের হিলি বন্দরের একজন পেঁয়াজ-রসুন ব্যবসায়ী। ১১ নভেম্বর রাতে আশরাফুল রংপুর থেকে বন্ধু জরেজুলকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। ঢাকায় পৌঁছানোর পর থেকে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।
১৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় শাহবাগ থানা পুলিশ জাতীয় ঈদগাহ মাঠের গেটের কাছে দুটি ড্রাম থেকে ছাব্বিশ টুকরা খণ্ডিত একটি মৃতদেহ উদ্ধার করে। পরে আঙ্গুলের ছাপ মিলিয়ে পুলিশ তার পরিচয় নিশ্চিত হয় এবং পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হলে আশরাফুলের বোন মর্গে গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন এবং এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
উক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ছায়া তদন্ত আরম্ভ করে এবং ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ও তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় জড়িতদের অবস্থান শনাক্ত করে। এক পর্যায়ে শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) রাতে কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে হত্যাকাণ্ডে জড়িত মোহাম্মদ জরেজুল ইসলামকে গ্রেফতার করে ডিবি। তার দেখানো মতে সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি চাপাতি এবং ভাড়া করা বাসা থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত স্কচটেপ ও হাতুড়ি উদ্ধার করা হয়।
উক্ত ঘটনা সম্পর্কে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মোঃ শফিকুল ইসলাম বিপিএম, পিপিএম জানান, গ্রেপ্তারকৃত জরেজুল ইসলাম একজন মালয়েশিয়া প্রবাসী। অনুমান দেড় মাস পূর্বে সে দেশে আসে। বিদেশে থাকাকালীন জরেজুল ইসলামের সাথে “বিগো লাইভ” অ্যাপের মাধ্যমে কুমিল্লা জেলার শামীমা ইসলাম নামে এক প্রবাসীর স্ত্রীর সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। জরেজুল ইসলাম দেশে ফেরার পর তার স্ত্রী বিষয়টি জানতে পারলে তাদের মধ্যে পারিবারিক মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। জরেজুলের স্ত্রী বিষয়টি জানতে পেরে জরেজুল ইসলামের বন্ধু আশরাফুলকে শামীমার মোবাইল নম্বর দেন তার বন্ধু জরেজুল ইসলামকে এসব থেকে নির্বৃত্ত করার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু আশরাফুল নিজেই এক পর্যায়ে শামীমার সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।
প্রাথমিকভাবে জানা যায়, নিহত আশরাফুল তার বন্ধুকে ১৪ লক্ষ টাকা দিয়ে জাপান পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেয়, তার মধ্যে শামীমা ৭ লক্ষ টাকা দেয়ার কথা ছিলো। মূলত এই টাকার সংস্থান এবং শামীমার সাথে একান্তে দেখা করার আশায় দুই বন্ধু একত্রে রংপুর থেকে ঢাকায় আসে। ঢাকায় তিনজন একত্রে দেখা করার জন্য একটি নিরাপদ স্থান খোঁজ করছিলো। পরে তিনজনের পরিকল্পনায় তারা ডেমরা থানাধীন ব্যাংক কলোনি এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নেয় এবং একইদিন দুপুর ২.৩০ ঘটিকায় বাসায় ওঠে তিনজন মিলে সেই বাসা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে। স্থানীয় বাজার থেকে তারা একটি তোশক, তিনটি বালিশ ও জানালার পর্দা কেনে। পরস্পর সম্মতিতে তারা একে অপরের সাথে শারীরিক মেলামেশা করে কিন্তু আশরাফুল শামীমার সাথে অস্বাভাবিক পথে যৌনকর্ম করতে চাইলে শামীমা তাতে বাধা প্রদান করে। এতে করে দুজনের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয় এবং শামীমা কান্নাকাটি শুরু করলে জরেজুল বিষয়টি নিয়ে বন্ধুর ওপর হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে যান। আশরাফুল শামীমাকে জোরাজুরি করার এক পর্যায়ে শামীমা কৌশলে আশরাফুল এর হাত বেঁধে অস্বাভাবিক পথে মেলামেশা করতে প্রলুব্ধ করে। আশরাফুল এরপর অস্বাভাবিক পথে যৌনকর্ম শুরু করলে ক্ষিপ্ত জরেজুল প্রথমে আশরাফুলকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে। এতে আশরাফুল ডাক চিৎকার শুরু করলে শামীমা তাঁর ওড়না এবং সাথে থাকা স্কচটেপ দিয়ে আশরাফুল এর মুখ বেঁধে দেয়। এভাবে মুখ বাঁধা থাকায় এবং জরেজুল ইসলামের আঘাতে এক পর্যায়ে আশরাফুল মারা যায়।
আশরাফুল মারা গেলে দুজনে চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং লাশ গুম করার উপায় খুঁজতে থাকে। ১২ নভেম্বর সারারাত তারা লাশের সাথেই একই বাসায় অবস্থান করে এবং ১৩ নভেম্বর সকালে জরেজুল ইসলাম ও শামীমা দুজনে পরিকল্পনা করে লাশ গুম করার জন্য বাজার থেকে দুইটি প্লাস্টিকের ড্রাম, পলিথিন ও লাশ কাটার জন্য স্থানীয় দোকান থেকে একটি চাপাতি কিনে আনে। বাথরুমের পানির ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে জরেজুল ইসলাম লাশটি কেটে টুকরা করে শামীমার সহায়তায় ড্রামে ভরে। শামীমা তখন বাইরে গিয়ে একটি সিএনজি ভাড়া করে আনে এবং দুজনে সিএনজিতে করে লাশের ড্রামসহ বেরিয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) হাইকোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠের পাশে ফুটপাতে তারা লাশ ভর্তি ড্রাম দুইটি রেখে দ্রুত বাসায় ফিরে যায়। বাসায় ফিরে দুজনে বাসার সকল মালামাল নিয়ে বের হয়ে যায়। শামীমা কুমিল্লার দিকে রওয়ানা হয় এবং জরেজ রংপুর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এক পর্যায়ে সে সিদ্ধান্ত বদল করে কুমিল্লায় তার এক বন্ধুর বাসায় গমন করলে সেখান থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কাজ অব্যাহত রয়েছে এবং গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন।
আরও পড়ুন:








