২০০৬ সালের অক্টোবর মাসজুড়ে সারাদেশে বিরাজ করেছে তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতা। কারণ সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে মানতে নারাজ আওয়ামী লীগ।
২৮ অক্টোবর ছিল বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিন। ওই দিন ঢাকার রাস্তায় প্রকাশ্যে অস্ত্র তুলে গুলি এবং মানুষ পিটিয়ে মানুষ হত্যা করেছিলো আওয়ামী লীগ। ২৮ অক্টোবরের আগের দিন এবং পরের দিনও দেশের বিভিন্ন জায়গায় লগী-বৈঠার রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়িয়েছে দলটি।
রাজধানীর বায়তুল মোকাররম এলাকায় প্রকাশ্যে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে জামায়াত-শিবিরের ৬ নেতা-কর্মীকে হত্যা করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। বিএনপি-জামায়াতের দাবি, একদলীয় শাসনের গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই সেদিন রাজপথে তাণ্ডব চালায় আওয়ামী লীগ। রাজপথে লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যার পর সেই লাশের ওপর নৃত্যের ঘটনা দেশের ইতিহাসে নৃশংসতার এক নজির হয়ে আছে।
২৭ অক্টোবর রাত ১২টার পর অষ্টম জাতীয় সংসদের বিলুপ্তি ঘটে। শেষ হয় বিএনপি সরকারের মেয়াদ। পরদিন বঙ্গভবনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার শপথ হওয়ার কথা ছিল। তবে, ২৭ অক্টোবর রাতে কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করে।
এমন অবস্থায় ২৮ অক্টোবর ঢাকায় সমাবেশের ঘোষণা দেয় জামায়াতে ইসলামী, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। পল্টন ময়দানে সমাবেশের ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া বিএনপি নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে এবং জামায়াতে ইসলামী বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে সমাবেশের ঘোষণা দেয়।
পল্টন ময়দানে সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছিল শ্রমিক দলও। সংঘাতের আশংকায় পল্টন ময়দান এবং আশপাশের এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ঢাকা মহানগর পুলিশ।
২৮ অক্টোবর সকাল থেকেই বায়তুল মোকারমের উত্তর গেইট থেকে শুরু করে পল্টন এবং তোপখানা মোড়ে অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। আওয়ামী লীগের সাথে ১৪ দলীয় জোটের অন্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও ছিলো। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর সাথে ছিল তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীরা।
আওয়ামী লীগ কর্মীরা দৈনিক বাংলার দিকে এগিয়ে যেতে চাইলে জামায়াতের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে তারা। একের পর এক বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে গোটা এলাকা। ইটের আঘাতে এক ব্যক্তি রাস্তায় লুটিয়ে পড়লে তাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটাতে থাকে আওয়ামী লীগ কর্মীরা। এরপর ওই ব্যক্তিকে ঘিরে স্লোগানও দিতে থাকে তারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২৮ অক্টোবরে লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যা আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। রক্তাক্ত ওই দিন রাজনীতির ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে বলে মনে করছেন তারা।
২০২৩ সালের ২৮ আক্টোবরও স্বৈরাচার সরকার পতনের এক দফা দাবিতে নয়াপল্টনে বিএনপি এবং মতিঝিলে মহাসমাবেশ করে জামায়াতে ইসলামী। সে সমাবেশেও ২০০৬ সালের মতো পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের যৌথ সশস্ত্র হামলায় মহাসমাবেশ পন্ড হয়ে যায়। সেদিন সন্ত্রাসীদের হামলায় প্রাণ হারান যুবদলের এক নেতা। আওয়ামী সন্ত্রাসী ও পুলিশের ছোড়া গুলি, বোমা ও কাঁদানে গ্যাসে আহত হয়েছে বিএনপি এবং জামায়াতের কয়েকশ নেতাকর্মী। প্রতিবাদে পরদিন সারাদেশে হরতাল পালন করে বিএনপি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে পতন ঘটে দানব হয়ে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের। দীর্ঘ ১৬ বছর পর দেশের মানুষ গণতন্ত্র ফিরে পায়। তবে এখনও ২৮ অক্টোবর দেশের ইতিহাসে এক ভয়াল দিন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে।
আরও পড়ুন:








