বুধবার

১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ ২ পৌষ, ১৪৩২

জি-টু-জিতে নিম্নমানের সার আমদানি; শত শত কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৬ অক্টোবর, ২০২৫ ১৯:২১

শেয়ার

জি-টু-জিতে নিম্নমানের সার আমদানি; শত শত কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ
সংগৃহীত ছবি

সার আমদানি সংক্রান্ত পরিপত্রের নিয়ম-কানুনকে কোনো প্রকার তোয়াক্কা না করে জি-টু-জি পদ্ধতিতে নিম্নমানের সার আমদানির অভিযোগ উঠেছে বিএডিসির বিরুদ্ধে। এছাড়া ভেজাল ও নিম্নমানের সার আমদানির নামে রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকা পাচার করা হচ্ছে।

সম্প্রতি থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হয় ইফা কনফারেন্স। সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং ট্রেডিং কোম্পানির মালিক ও প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। ওই কনফারেন্সে জি-টু-জি পদ্ধতিতে ভেজাল ও নিম্নমানের সার আমদানির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছেএ বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়।

জানা গেছে, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে রাষ্ট্রীয়ভাবে চুক্তিবদ্ধ হয়ে জি-টু-জির মাধ্যমে সেই দেশের সরকারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে সার আমদানি করে থাকে। চুক্তি অনুযায়ী, সেই দেশের কোনো বেসরকারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা ট্রেডিং কোম্পানির কাছ থেকে সার আমদানির কোনো সুযোগ নেই।

কিন্তু সার আমদানির পরিপত্রের নিয়মনীতি উপেক্ষা করে জি-টু-জি চুক্তির নামে চীনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বানিয়া ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং লিমিটেড (ঠিকানা: গ্লু ডিস্ট্রিক্ট, ফুজিয়া, চায়না)-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় বিএডিসি। প্রথম বছর বিএডিসি ওই প্রতিষ্ঠানটিকে রপ্তানিকারক হিসেবে দেখিয়ে চীনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইউয়া এবং শ্যাং ফ্যাং নামের দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে নিম্নমানের সার ক্রয় করে বাংলাদেশে পাঠায়।

বিএডিসির লেটার অব ক্রেডিটের (এলসি) মাধ্যমে সরকারি নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বানিয়া ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং লিমিটেড বিভিন্ন বেসরকারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ভেজাল ও নিম্নমানের সার ক্রয় করে। পরের বছর থেকেই বানিয়া ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং লিমিটেড নিজেকে আমদানিকারক সাজিয়ে ইউয়া ও শ্যাং ফ্যাং নামক দুই প্রতিষ্ঠান থেকে সার ক্রয় করে দেশে সরবরাহ করে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বানিয়া ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং লিমিটেডকে কৃষি মন্ত্রণালয় ও বিএডিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কাগজপত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখিয়ে সার সরবরাহের অনুমতি দেন। এছাড়া বিএডিসি চীনের এই প্রতিষ্ঠানটিকে যেকোনো কোম্পানি থেকে সার আমদানির ও যেকোনো বন্দর ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করে।

একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, চীনা ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সারে ১৮% নাইট্রোজেন ও ৪৬% ফসফেটসহ মোট ৬৪% উপাদান থাকার কথা এলসিতে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বানিয়া ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং লিমিটেডকে যেকোনো প্রতিষ্ঠান থেকে সার আমদানির অনুমতি দেওয়ায় তারা ৬৪% মানের সারের সঙ্গে ৫৭% মানের ডিএপি সার মিশিয়ে রাতের অন্ধকারে জাহাজে লোড করছে। এই ৫৭% সারের মধ্যে রয়েছে ৪৩% ফসফেট ও ১৪% নাইট্রোজেন।

ডিএপি সারে নাইট্রোজেন ও ফসফেট ৬৪% হিসেবে চীন থেকে আমদানিকৃত প্রতি মেট্রিক টন সারের মূল্য, জাহাজ ভাড়া ও অন্যান্য খরচসহ ৮৯০ থেকে ৮৯৫ মার্কিন ডলার। কিন্তু প্রতি মেট্রিক টনে ৭% নাইট্রোজেন ও ফসফেট কম দেওয়ায় প্রতিটন সারের মূল্য কমে যায় প্রায় ১০০ মার্কিন ডলার।

সূত্রটি আরও জানায়, চীনের বেসরকারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ৩ থেকে ৪ ধরনের গ্রেডের ডিএপি সার উৎপাদন করে। এ কারণেই ৬৪% মানের সারের সঙ্গে ৫৭% মানের সার মেশানো সহজ হচ্ছে।

আমদানিকৃত সার জাহাজীকরণের সময় চীনের স্থানীয় কোম্পানি বানিয়া ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং লিমিটেড প্রতি ৪০ হাজার মেট্রিক টন সারের মধ্যে ১৪ থেকে ১৫ হাজার মেট্রিক টন নিম্নমানের সার মিশ্রণ করে জাহাজে লোড দিচ্ছে। প্রথমে জাহাজের নিচে নিম্নমানের সার এবং তার উপরে মানসম্মত সার লোড করা হয়।

আগামী ৩০ অক্টোবর চীন থেকে ৪৪ হাজার মেট্রিক টনের আরও তিনটি জাহাজ নিম্নমানের সার নিয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হবে বলে জানা গেছে। সরকারের উচিত এখনই চীনে জাহাজে সার লোডিং বন্ধ করা। তা না হলে সেই সার ব্যবহার করলে দেশের প্রান্তিক চাষিদের ফসল উৎপাদনে ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে।

বিএডিসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নিম্নমানের সার দেশে আসার মূল কারণ হলো কন্টিনেন্টাল ইন্সপেকশন কোং (বিডি) লিমিটেড নামের একটি অখ্যাত ও নিম্নমানের বাংলাদেশি কোম্পানিকে পরিদর্শনের দায়িত্ব দেওয়া।

এ কোম্পানি এলসির ক্লজ অনুযায়ী সারের নাইট্রোজেন ও ফসফেটের পরিমাণ এবং গুণগত মান যাচাই করে সার্টিফিকেট দেয়। এই সার্টিফিকেটের ভিত্তিতেই রপ্তানিকারক ব্যাংক থেকে বিল উত্তোলন করে।

কিন্তু সাধারণত এমন আমদানিতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান যেমন এসজিএস (আমেরিকা) বা ইন্সপেক্টরেট দ্বারা গুণগতমান পরীক্ষার কথা থাকলেও, গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোনালী ব্যাংকের দেওয়া এলসিতে কন্টিনেন্টাল ইন্সপেকশন কোং (বিডি) লিমিটেড নামের এই প্রতিষ্ঠানটির নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

এর ফলে এই চক্রটি এলসির মাধ্যমে অর্থ পাচার সহজে করতে পারছে। কন্টিনেন্টাল ইন্সপেকশন কোং (বিডি) লিমিটেড শুধু পাচারের সহযোগী নয়তারা দেশের ১৩ কোটি প্রান্তিক কৃষকের সাথেও প্রতারণা করছে।

আমদানিকৃত সারে ৫০% থেকে ৫৫% নাইট্রোজেন ও ফসফেট মেশানোর কারণে প্রতি মেট্রিক টনে ৯৫ থেকে ১০০ মার্কিন ডলার করে পাচার হচ্ছে। একইভাবে তিউনিসিয়া ও মরক্কো থেকে আমদানিকৃত হাজার হাজার কোটি টাকার টিএসপি সারের গুণগতমান পরীক্ষার দায়িত্বও এই অখ্যাত প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে।

সূত্রটি জানায়, কানাডা ও রাশিয়া থেকে সার আমদানিতে প্রতি জাহাজে ৩০ হাজার মেট্রিক টন সারের সীমা থাকলেও, বর্তমানে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার মেট্রিক টন করে সার আমদানি হচ্ছে। এতে প্রতি টন সারে ১৫ থেকে ২০ ডলার অতিরিক্ত আদায় করা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছেএই অতিরিক্ত অর্থ কার পকেটে যাচ্ছে?

এই কন্টিনেন্টাল ইন্সপেকশন কোং (বিডি) লিমিটেডের ঠিকানা রাজধানীর বাড্ডার প্রগতি সরণির ট্রপিক্যাল মোল্লা টাওয়ারে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি মাসে এসব এলসি অডিট করলেও কীভাবে এদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অর্থ পাচার হচ্ছে, সেটাই এখন প্রশ্ন।

সূত্রটি আরও জানায়, বিএডিসির এআরও-তে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, আমদানিকৃত ডিএপি সারে আর্দ্রতার হার সর্বোচ্চ ১% থাকতে হবে। কিন্তু ১৪/০৯/২০২৫ তারিখে সোনালী ব্যাংকের লোকাল শাখা থেকে প্রদত্ত লেটার অব ক্রেডিটে (এলসি) আর্দ্রতার হার ১.৫% উল্লেখ করা হয়েছে, যা পরিপত্রবিরোধী।

এভাবে এলসিতে অতিরিক্ত আর্দ্রতার হার দেখিয়ে শত শত কোটি টাকা পাচার করা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, প্রতি মেট্রিক টনে ৭% নাইট্রোজেন ও ফসফেট কম প্রদান করায় ১০০ মার্কিন ডলার অতিরিক্ত পাচার হচ্ছে। প্রতি ৪০ হাজার মেট্রিক টনের জাহাজে ১২২ টাকা বিনিময় হারে প্রায় ১৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা পাচার হচ্ছে প্রতিবার।

এদিকে তিউনিসিয়া ও মরক্কো থেকে মোজাইক কোম্পানির মাধ্যমে আমদানিকৃত ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি) সারে ডাস্ট ও হেভি মেটাল সার মিশ্রণ রয়েছে। এতে ১০% সোডিয়াম থাকার কথা থাকলেও কম পরিমাণে রয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় প্রতি জাহাজে প্রায় ১৪-১৫ হাজার মেট্রিক টন ভেজাল সার মেশানো হচ্ছে, যা এলসির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা পাচারে ব্যবহৃত হচ্ছে।

কে এই কন্টিনেন্টাল ইন্সপেকশন কোং (বিডি) লিমিটেডের মালিক?

এই প্রতিষ্ঠানের মালিক মোহাম্মদ উল্লাহ। তিনি গত ১৫ বছর ধরে বিএডিসি ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে এলসির মাধ্যমে বিদেশি সারের অনিয়ম, দুর্নীতি ও প্রতারণা করে আসছেন।

মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত মোহাম্মদ উল্লাহর ব্যবসায়িক অংশীদার হলেন সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের জামাতা পরিচয়দানকারী মো. সাব্বির হোসেন। সাব্বির হোসেন মালয়েশিয়া থেকে বিএডিসির এজেন্ট হিসেবে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

সাধারণত ইন্সপেকশন কোম্পানির বিল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রদান করে, কিন্তু এই কোম্পানির বিল দিচ্ছে বিএডিসিযা বিধিবহির্ভূত।

এই কোম্পানি প্রকৃতভাবে ইন্সপেকশন না করে নিজেদের মতো করে রিপোর্ট তৈরি করে দিচ্ছে, ফলে শত শত কোটি টাকা পাচার হচ্ছে।

আন্তর্জাতিকভাবে আমদানিকৃত পণ্য ইন্সপেকশন করার জন্য কোনো লোকাল প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নেই। তথাপি এই অখ্যাত কোম্পানিটিকে ইন্সপেকশনের দায়িত্ব দিয়ে পাচারকে বৈধতার রূপ দেওয়া হচ্ছে।

এই কোম্পানির ঠিকানা রাজধানীর বাড্ডার ট্রপিক্যাল মোল্লা টাওয়ারে।

মোহাম্মদ উল্লাহ গত ১০ বছর ধরে এই প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

তার সহযোগী সাব্বির হোসেন বর্তমানে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করে বিএডিসি ও বিদেশি আমদানিকারকদের মধ্যে মধ্যস্থতা করছেন এবং বিদেশ থেকে শত শত কোটি টাকা গ্রহণ করছেন।

অভিযোগ উঠেছেচীন, তিউনিসিয়া, মরক্কো, কানাডা থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার সার আমদানির গুণগতমান পরীক্ষার দায়িত্ব এই অখ্যাত কন্টিনেন্টাল ইন্সপেকশন কোং (বিডি) লিমিটেড-কে কেন দেওয়া হয়েছে,

সে বিষয়ে তদন্তের জোর দাবি উঠেছে।



banner close
banner close