ভবন লাগোয়া খুঁটি, জরাজীর্ণ তার, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, আবার বহুতল এসব ভবনের উপরের অংশে টিনের দেয়াল, এমন ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর দেখা মিলবে মিরপুরের রূপনগর এলাকায়। যার কোনটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, ওয়াশিং–ডাইং কিংবা প্রিন্টিং প্রতিষ্ঠান! আবার কোন কোনটিতে মজুত থাকে নানাপ্রকার বিষাক্ত কেমিক্যাল।
১৪ অক্টোবর তেমনই একটি অনিরাপদ-অনুমোদনহীন রাসায়নিক গুদামঘরে ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ! দেয়াল ভেঙে পাশের গার্মেন্টস, প্রিন্টিং ও ওয়াশিং ফ্যাক্টরিতে ছড়িয়ে পড়ে আগুন, তারও আগে ছড়ায় কেমিক্যালের বিষাক্ত ধোঁয়া। রাসায়নিক সেই বিষক্রিয়ায় জ্ঞান হারান কর্মরত শ্রমিকরা। তাদের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন শিশু-নারীসহ ১৬ জন।
রূপনগরে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি-বিএউবিটি’র ক্যাম্পাসের ঠিক পাশের গলিতেই আলম ট্রেডার্স নামে কেমিক্যাল গুদামে ঘটে ভয়াবহ এই বিস্ফোরণের ঘটনা। পুরো এলাকাজুড়ে কেবল বিইউবিটি নয়, মনিপুর স্কুল, কমার্স কলেজসহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান ঘিরেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য কারখানা, আর তারই মাঝে এমন রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদঘর। শিক্ষা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ছাত্রাবাস-আবাসিক এলাকা, বাজার, শপিং মলও রয়েছে।
রূপনগরের এই শিয়ালগাড়িতে গড়ে ওঠা ভবনগুলো নির্মাণে যেমন মানা হয়নি রাজউকের নীতিমালা, তেমনি এসব প্রতিষ্ঠানে অবস্থিত কারখানাগুলোর বেশিরভাগেই নেই নিয়ম-নীতির কোন বালাই! অথচ স্থানীয় প্রশাসন, কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, শ্রম বিভাগসহ সরকারের নানা প্রতিষ্ঠান রয়েছে এইসব শিল্পকারখানার নিয়মতান্ত্রিক পরিচালনা নিশ্চিত করার জন্য।
ঝুঁকিপূর্ণ এইসব কারখানাগুলোতে কর্মরত হাজারো শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়েও উদাসীন প্রতিষ্ঠান মালিক থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্তারা—সকলেই! উল্টো কারখানা চলার সময় প্রতিটি ফ্লোরে তালা দিয়ে রাখার অভিযোগও করেন শ্রমিকরা।
অন্যদিকে, কোন কারখানা-গুদামঘর কিংবা ভবন গড়ে তুলতে প্রধানতম শর্তই থাকে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র গ্রহণ। আর তার জন্য মানতে হয় কয়েক ধাপে বিশেষ কিছু শর্ত। তবে দৃশ্যত সেসব কোন শর্ত না মেনেই কীভাবে গড়ে উঠলো শত শত ভবন, কী করেই বা এমন ভয়ঙ্কর রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদঘর—সে প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের কাছে।
বারবার যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া মেলেনি তদারকি প্রতিষ্ঠান কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শকের।
এদিকে, বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে এ ঘটনায় আলম ট্রেডার্সের মালিক মোহাম্মদ শাহ আলমসহ দুই জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত নামা কয়েকজনের বিরুদ্ধে রূপনগর থানায় মামলা করেছেন নিহতদের স্বজনরা। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, অভিযুক্ত আসামীদের ধরতে অভিযান চলমান রয়েছে।
তবে আলম ট্রেডার্সের সামনে ক্ষতিগ্রস্ত একটি ওয়াশিং কারখানার মালিককে আটক করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেছে কর্মীরা। তাদের দাবি, অবৈধ কেমিক্যাল গুদামের মালিক শাহ আলমকে বাঁচাতে মামলাটিকে ভিন্ন খাতে নেয়ার অপচেষ্টা চলছে।
মিরপুরের রূপনগর এলাকার এই গলিগুলোর প্রতিটিতেই দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর সব আয়োজন রীতিমতো নিশ্চিত করে রাখা হয়েছে! লাগোয়া ভবনগুলোর বেশিরভাগই যেমন মানেনি কোনো বিল্ডিং কোড, তেমনি নেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার বালাই! অন্যদিকে, কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের প্রধানতম কাজই হলো এইসব দেখভাল করা! আছে রাজউক, ফায়ার সার্ভিসসহ আরও বেশ কয়েকটি সরকারি সংস্থা! এরমধ্য দিয়ে, রাষ্ট্রীয় একাধিক প্রতিষ্ঠানের মদদেই এমন মৃত্যুফাঁদ প্রতিষ্ঠিত হয়ে চলছে যুগের পর যুগ ধরে।
বিস্তারিত ভিডিও লিংকে: https://www.youtube.com/watch?v=FET_vrWpzL0
আরও পড়ুন:








