সোমবার

১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১ পৌষ, ১৪৩২

ঢাকা মেডিকেলে রক্তচক্র: রক্তের নামে মানুষ কিনছে মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১২ অক্টোবর, ২০২৫ ১৫:১৫

আপডেট: ১২ অক্টোবর, ২০২৫ ২১:৫১

শেয়ার

ঢাকা মেডিকেলে রক্তচক্র: রক্তের নামে মানুষ কিনছে মৃত্যু
ছবি: সংগৃহীত

কয়েকটি ব্যাগ থেকে অল্প অল্প রক্ত নিয়ে আরেকটি নতুন ব্যাগ তৈরি করেন, প্রয়োজনে নরমাল স্যালাইন মিশিয়ে পরিমাণ বাড়িয়ে বাইরে উচ্চমূল্যে বিক্রি করেন।

এটি কোনো চলচ্চিত্রের সংলাপ নয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সরকারি শোকজ লেটারে লেখা বাস্তব ঘটনা। দেশের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন এই চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানেই রক্ত চুরি, বিক্রি এবং মিশ্রণের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ ঘটছে বছরের পর বছর ধরে। বাংলা এডিশনের হাতে আসা অন্তত চারটি শোকজ লেটারে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।

ফ্রিজ থেকে রক্ত ও প্লাজমা চুরি করে দালালদের হাতে তুলে দেয়া, রক্তদাতার কাছ থেকে অতিরিক্ত রক্ত সংগ্রহ, এবং ব্যাগের লেবেল বদলে দেয়া এমন অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছেন কয়েকজন কর্মচারী।

অভিযোগের মুখে রয়েছেন, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট মো. মুন্নাফ হোসেন, ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট মুরাদ মিয়া, অফিস সহায়ক সামসুদ্দিন মিন্টু ও মো. মনিরুজ্জামান। ডিএমসিএইচ ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের প্রধানের স্বাক্ষরিত এই শোকজ লেটারের কপি পাঠানো হয় হাসপাতাল পরিচালক বরাবর।

হাসপাতালের এসব কর্মী পকেটে করে রক্ত ও প্লাজমা চুরি করে নিয়ে যান। এমনকি, ব্লাড ব্যাগে চিকিৎসকদের লেখা তথ্য মুছে নিজেরা নতুন তথ্য লিখে রাখেন।

ভয়ঙ্কর অপরাধের অভিযোগ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন অভিযুক্তরা। এর প্রেক্ষিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দিয়েছে নামমাত্র শাস্তি মুন্নাফকে ট্রান্সফিউশন বিভাগ থেকে সরিয়ে ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিতে, মনিরুজ্জামানকে অটোক্লেভ শাখায়, এবং মুরাদ মিয়াকে প্যাথলজি বিভাগে বদলি করা হয়েছে।

বাংলা এডিশনের অনুসন্ধান বলছে, অপরাধ প্রমাণের পরও শাস্তি নয়, বরং বদলির মধ্য দিয়েই রক্ষা করা হচ্ছে অভিযুক্তদের। বদলিকৃত বিভাগে গিয়ে টানা কয়েক দিনেও মেলেনি তাদের খোঁজ।

সরকারি দপ্তরের শোকজ লেটারগুলোতে উল্লেখিত অপরাধগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হলো, একাধিক ব্যাগ থেকে রক্ত সংগ্রহ করে একটি ব্যাগ তৈরি করা। এমন মিশ্রিত রক্ত মানব শরীরে প্রবেশ করলে কী ঘটতে পারে, তা জানালেন হাসপাতালটির ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের প্রধান নিজেই!

অর্থাৎ এক গ্রুপের রক্ত অন্য গ্রুপে দিলে হিমোলাইটিক রিয়্যাকশন হয়। মিশ্রিত রক্ত মানে একসাথে একাধিক অ্যান্টিবডিএই প্রতিক্রিয়ায় কখনও ঘণ্টায়, কখনও মিনিটের মধ্যেই মৃত্যু হতে পারে মানুষের! একটি ব্যাগে একাধিক গ্রুপের রক্ত মিশে গেলে মৃত্যু ঝুঁকি শতভাগ।

জীবন বাঁচাতে অপরিহার্য যে রক্ত, সেই রক্ত নিয়েই এমন মরণখেলায় মেতে থাকা সংঘবদ্ধ চক্রের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে শাখা বদলের মতো নামমাত্র সাজা দেওয়া হয়েছে। এই প্রশ্নে কোনো জবাব না পেলেও, পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তনের কথা জানালেন বিভাগীয় প্রধান।

অন্যদিকে, হাসপাতালের অভ্যন্তরে ঘটে চলা ভয়ঙ্কর এসব ঘটনার কোনো খবরই যায় না স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। রক্তের নামে মানুষের শরীরে বিষ ঢালার অপরাধে কয়েক কর্মচারীকে শোকজ করার বিষয়েও কিছুই জানেন না স্বাস্থ্যের কর্তারা! বাংলা এডিশনের হাতে থাকা শোকজ লেটারে উল্লেখিত অপরাধের ধরন জেনে রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করলেন অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা।

আর আইনজীবীরা বলছেন, মানুষের প্রাণঘাতী এমন অপকর্ম রীতিমতো ফৌজদারি অপরাধ। চাকরি থেকে বরখাস্ত নয়, হাসপাতাল প্রশাসনেরই উচিত প্রমাণিত এসব অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা।

দেশের প্রাচীন ও সবচেয়ে বড় এই চিকিৎসাকেন্দ্রকে ঘিরে রক্ত কেনাবেচার বিরাট একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। হাসপাতালের কর্মীদের সহযোগিতায় এই সিন্ডিকেট সদস্যরা দিনভর হাসপাতাল প্রাঙ্গণেই অবস্থান করে অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে। সিসিটিভি ক্যামেরায় ঘেরা হাসপাতাল কম্পাউন্ডে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের সাথেও গড়ে তুলেছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।

তাই শুধু কর্মচারীরাই নয়, হাসপাতালে এমন বিশেষ বিশেষ শাখায় কাজ করতে আনসার সদস্যরাও করে থাকেন তদবির।

বাংলা এডিশনের গোপন ক্যামেরায় দেখা মেলে দালাল চক্রের কয়েক সদস্যের। ধরা পড়ে রক্তের ব্যাগ আর টাকার বিনিময়ের দৃশ্যও।

কয়েক দিনের অনুসন্ধানে এই চক্রের অন্যতম হোতা হিসেবে উঠে আসে ফরিদ খান নামে এক ব্যক্তির নাম। দেখা হয় তার সঙ্গেও প্রথমে গোয়েন্দা সদস্য পরিচয় দিলেও পরে স্বীকার করেন চাকরি না করেও দিনভর হাসপাতালে কাটান তিনি। তবে কী করেন এখানেতার কোনো উত্তর মেলেনি।

আনসার সদস্যরা কেন তাদের দেখেও দেখেন না, সেই প্রশ্নেরও উত্তর মেলেনি। আনসার সদস্যদের নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সাধারন মানুষও।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট, অফিস সহায়কসহ মিন্টু, হাশেম, মুন্নাফ, মুরাদ, মনিরুজ্জামানসহ আরও কয়েকজন বহিরাগত ব্যক্তি এই দালাল চক্রের সঙ্গে যোগসাজশে নানা অপকর্ম করে আসছেন। এদের বেশিরভাগই বছরের পর বছর ধরে একই বিভাগে কর্মরত। অভ্যন্তরীণ এই সিন্ডিকেটের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে উঠে আসে আরেকটি নাম দেলোয়ার হোসেন। বর্তমানে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এই দেলোয়ার ২০১০ সাল থেকে এখানেই আছেন। তবে, তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।

মানবসেবার ব্রত নিয়ে রক্ত দিতে আসা ডোনাররা দালালদের এসব কর্মকাণ্ডে দিনদিন আগ্রহ হারাচ্ছেন।

রক্ত নিয়ে যেমন ভয়ঙ্কর সব অপরাধ ঘটছে, তেমনি একদল চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন হাসপাতালটিকে আরও জনবান্ধব ও প্রকৃত সেবাদানকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে। তাদেরই একজন, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ফাহমিদা জানান, দালালরা নানা ভ্রান্ত তথ্য দিলেও রক্তের সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা হাসপাতালেই হয়, এবং বর্তমানে কোনো রক্তের সংকট নেই।

বিভিন্ন বিভাগে ভর্তি রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত ও রক্ত-সম্পর্কিত সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষার আধুনিক ব্যবস্থা রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও কর্মীরা রোগীর স্বজনদের হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক থেকেই রক্ত সংগ্রহ করতে সচেতন করলে অনেকটা সুফল মিলবে বলেও মনে করেন এই চিকিৎসক।

সরেজমিনে দেখা যায় দিনভর অসংখ্য মানুষ রক্ত প্রদান ও সংগ্রহ করছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ থেকে। সময় নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করছেন প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীরা।

রক্ত দাদুর কাছে গেলে কয়েক মিনিটেই হয়ে যায়, এমনসব বিভ্রান্তিকর কথা ছড়িয়ে রোগী ও স্বজনদের প্রলুব্ধ করে হাসপাতালের ভেতরে ওঁত পেতে থাকা দালাল চক্রের সদস্যরা। তাদের এসব কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ব্লাড ব্যাংক বা ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগে যোগাযোগ করতে আহ্বান জানান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

জীবন বাঁচানোর রক্তই যদি মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হয়, তবে প্রশ্ন জাগে, মানুষের ভেতরকার অমানুষটা কে থামাবে? ঢাকা মেডিকেলের দেয়াল জুড়ে আজও রক্তের দাগ শুকায় না শুকিয়ে গেছে শুধু মানবতার রঙটা।

নীরব এই মৃত্যুবাণিজ্যের বিচার চায় রক্তদাতা, রোগী স্বজনসহ প্রতিটি মানুষ।

বিস্তারিত ভিডিও লিংকে: https://www.youtube.com/watch?v=WylFI5X33r4



banner close
banner close