রবিবার

১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৩০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

দেশে মাথাপিছু জলবায়ু ঋণ ৭৯.৬ মার্কিন ডলার

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ২১:৪৯

আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ২১:৫০

শেয়ার

দেশে মাথাপিছু জলবায়ু ঋণ ৭৯.৬ মার্কিন ডলার
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের মাত্র ০ দশমিক ৫ শতাংশের জন্য দায়ী হলেও, বর্তমানে দেশে মাথাপিছু জলবায়ু ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৯ দশমিক ৬ মার্কিন ডলার। যা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম শীর্ষ। বাংলাদেশের ঋণ-অনুদান অনুপাত (২ দশমিক ৭) স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) তুলনায় প্রায় চারগুণ (০ দশমিক ৭)। এছাড়া, বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংক (এমডিবি) থেকে গৃহীত ঋণের অনুপাত ০ দশমিক ৯৪, যা বৈশ্বিক গড় ০ দশমিক ১৯-এর প্রায় পাঁচগুণ বেশি। ‘ক্লাইমেট ডেট রিস্ক ইনডেক্স (সিডিআরআই-২০২৫)’এ এই তথ্য উঠে এসেছে।

শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জলবায়ু বিষয়ক গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ। গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম. জাকির হোসেন খান; ফলাফল উপস্থাপন করেন সহ-গবেষক তন্ময় সাহা।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের ১৩ কোটিরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১,৩৬০ কোটি মার্কিন ডলার। এতকিছুর পরেও জলবায়ু অভিযোজন খাতে সহায়তা নগণ্য। অন্যদিকে, দেশের পরিবারগুলো স্ব-অর্থায়নে জলবায়ু ঘটিত বিপর্যয় থেকে সুরক্ষা ব্যবস্থার জন্য প্রতি বছর মাথাপিছু গড়ে ১০,৭০০ টাকা (প্রায় ৮৮ মার্কিন ডলার) ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছে, যা জাতীয় পর্যায়ে বার্ষিক ১৭০ কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়। প্যারিস চুক্তির ‘ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রতিশ্রুত আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন ব্যবস্থাটি কীভাবে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য একটি ‘জলবায়ু ঋণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। জলবায়ু অর্থায়নের ৭০ শতাংশেরও বেশি আসে ঋণ হিসেবে, যা সংকটাপন্ন দেশগুলোকে দ্বিগুণ ক্ষতির মুখে ফেলছে।

গবেষণা প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, অভিযোজন-প্রশমন অনুপাত মাত্র ০ দশমিক ৪২, যা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর গড় মানের (০.৮৮) অর্ধেকেরও কম পাচ্ছে বাংলাদেশ। প্রতি টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের জন্য বাংলাদেশকে ২৯ দশমিক ৫২ মার্কিন ডলার ঋণ নিতে বাধ্য করা হচ্ছে যা ‘পলিউটারস পে প্রিন্সিপাল নীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বাংলাদেশের জন্য রিপোর্টকৃত ‘জলবায়ু অর্থায়নের ১৮ দশমিক ৮৪% জীবাশ্ম জ্বালানি প্রকল্পে ভুলভাবে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। এই প্রকল্পগুলোতে ঋণ-অনুদান অনুপাত ২৮ দশমিক ৮, যা বাংলাদেশের সামগ্রিক ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং প্রকৃত জলবায়ু সমাধানকে বাধাগ্রস্ত করছে যা অর্থায়নের নামে সুস্পষ্ট প্রতারণা।

তাৎক্ষণিক করণীয় তুলে ধরে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযোজন খাতের কমপক্ষে ৭০% এবং ক্ষয়ক্ষতি (Loss and Damage) খাতের ১০০% অর্থায়ন অনুদান হিসেবে আসতে হবে। শুধুমাত্র যেখানে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক ও ন্যায্য, সেখানেই সহজ শর্তে ঋণ গ্রহণযোগ্য। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঋণ বাতিল করতে হবে এবং প্রকৃতি/জলবায়ু সুরক্ষার বিনিময়ে ঋণ মওকুফ (debt-for-nature/climate swaps) কার্যক্রম বাড়াতে হবে। পৌরসভা, স্থানীয় সরকার এবং কমিউনিটিকে সহজসরল প্রক্রিয়ায় সরাসরি অর্থায়ন করতে হবে এবং উপ-জাতীয় পর্যায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। অনুদান বৃদ্ধি, অভিযোজন খাতে ভারসাম্য আনা, জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভুল বরাদ্দ বন্ধ এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনে দেশীয় প্ল্যাটফর্মকে সমর্থন করতে হবে। কার্বন প্রাইসিং এবং লেনদেন শুল্কের মাধ্যমে একটি বৈশ্বিক অনুদান ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা শর্তহীনভাবে দেশীয় মালিকানায় জলবায়ু সহনশীলতা প্রকল্পে অর্থায়ন করবে। বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ডকে ‘বাংলাদেশ ন্যাচারাল রাইটস ফান্ড (বিএনআরএফ)’-এ রূপান্তরিত করতে হবে, যা অধিকার-ভিত্তিক বরাদ্দ এবং কমিউনিটির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে। দূষণ কর ও কার্বন প্রাইসিংয়ের মতো নতুন অভ্যন্তরীণ উৎসও এর অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ বলেন, ‘জীববৈচিত্র্য রক্ষা করলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমে, কিন্তু COP-এর মতো বৈশ্বিক ফোরামে বাস্তব ফল কমফলে মানুষ ঝুঁকিতে থাকে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (ICJ) রায়ে উল্লেখিত অসম কার্বন নিঃসরণ প্রশ্নে বাংলাদেশকে সাড়া দিতে হবে এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ, জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা ও এনডিসি বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. এ. কে. ইনামুল হক বলেন, জলবায়ু বিজ্ঞান, তবু বাংলাদেশ গভীর ঝুঁকিতে। অনুদান সীমিত, ঋণের ঝুঁকি বেশি, বেসরকারি খাতে অতিনির্ভরতা আর্থিক চাপ বাড়ায়। ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের ওপর মানবপাচারের মতো হুমকিও থাকে। টেকসই শক্তি গড়তে স্থানীয় জ্ঞান, প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপরিবর্তন দরকারখণ্ড খণ্ড সমাধান যথেষ্ট নয়।

চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম. জাকির হোসেন খান বলেন, দৃঢ় অঙ্গীকার ও স্পষ্ট শাসনব্যবস্থা না থাকলে COP-29 –এ ঘোষিত ১ বিলিয়ন ডলারের ‘ক্লাইমেট ফাইন্যান্স অ্যাকশন ফান্ড উচ্চাশাই থেকে যাবে; ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য প্রকৃত লাইফলাইনে পরিণত হবে না।

ঢাকায় নিযুক্ত সুইডেন দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি ও ডেপুটি হেড অব ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন নায়োকা মার্টিনেজব্যাকস্ট্রম বলেন, জলবায়ু অর্থায়ন হতে হবে জবাবদিহিমূলক, ন্যায্য ও ফলদায়কসম্পদ রক্ষা ও ন্যায়সঙ্গত রূপান্তরের জন্য। অনুদানের বাইরে নতুন উৎস দরকার। ‘ক্লাইমেট ভলনারেবিলিটি ইনডেক্স ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাজেটিং বরাদ্দে পথ দেখাতে পারে, তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো কমিউনিটিতে বাস্তব প্রভাব। যে প্রকল্প সত্যিই অভিযোজনউপশমন এগোয়যেমন জনপরিবহনতাকেই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।

পিকেএসএফ-এর উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. ফজলে রাব্বি সাদেক আহমেদ বলেন, অ্যাডাপ্টেশন ফাইন্যান্স অনুদানভিত্তিক ও ন্যায়ের ভিত্তিতে না হলে বিশ্ব জলবায়ু ঋণসংকটে পড়তে পারেযেখানে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের বেঁচে থাকাই ব্যয়বহুল হয়ে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত সবার স্থিতিশীলতাই হুমকিতে পড়বে।

সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের কোঅপারেশন অফিসার শিরিন লিরা বলেন, বাংলাদেশ যদি জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারে-এবং অর্থ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের কাছে না পৌঁছায়তাহলে বৈশ্বিক অর্থায়ন পাওয়া কঠিন হবে। শুধু নীতি নয়; দুর্যোগে প্রথম সাড়া দেন স্থানীয় মানুষ। তাদের সক্ষমতা না বাড়ালে আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার মাঠে ফল দেবে না।

গ্রিনপিস দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার গ্রিনস্পিকার ফারিয়া হোসাইন ইকরা বলেন, বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে; ন্যায়সঙ্গত জলবায়ু অর্থায়ন পাওয়া আরও কঠিন হবে। বড় নিঃসরণকারীদের জবাবদিহিতে আনতে ও প্রাপ্য সহায়তা আদায়ে আইসিজের পরামর্শমূলক মতামত কীভাবে আইনি হাতিয়ার হতে পারেএটা খুঁজে দেখা দরকার।

বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী ড. সাইমন পারভেজ বলেন, বাংলাদেশের নিঃসরণ কম, প্রভাব বেশি। জলবায়ু অর্থায়ন ঋণনির্ভরতা থেকে সরে ন্যায় ও সমতার দিকে যেতে হবেস্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও বাস্তব অভিযোজন সহায়তা সহ। প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান, নৌপথ পুনরুদ্ধার, নবায়নযোগ্য শক্তি, জলবায়ুস্মার্ট কৃষিএসব কাজে বিশেষজ্ঞতা, জাতীয় অঙ্গীকার ও বৈশ্বিক সংহতি প্রয়োজন। জলবায়ু ঋণের যুগ শেষ হোক, জলবায়ু ন্যায়ের যুগ শুরু হোক।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) যুগ্মসচিব ড. কাজী শাহজাহান বলেন, জলবায়ু বিজ্ঞান রাজনীতি, অর্থনীতি ও মানব আচরণের সঙ্গে জড়িত। কার্যকর অর্থায়নের জন্য জাতীয়আন্তর্জাতিক নীতিমালা বুঝতে হবে, বৈশ্বিক উন্নয়ন কাঠামো থেকে শিখতে হবে এবং তথ্যসম্পদের কৌশলী ব্যবহার করতে স্থানীয় সক্ষমতা গড়তে হবে।



banner close
banner close