আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশনে (ইসি) চিঠি পাঠিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। চিঠিতে নির্বাচনের সময় হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাসের পাশাপাশি রোজা শুরুর আগেও উল্লেখ করা হয়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, এই চিঠির মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ইসিকে অনুরোধের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়েছে।
বুধবার ইসি কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদের কাছে পাঠানো চিঠিতে ‘উল্লিখিত সময়ে প্রত্যাশিত মানের অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের’ জন্য অনুরোধ জানান প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া।
এর আগের দিন মঙ্গলবার ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে রোজা শুরুর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য ইসিকে চিঠি দেবেন বলে জানান।
প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্যের পর গতকাল দিনভর রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে বাড়তি উদ্দীপনা লক্ষ্য করা গেছে। দুপুরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জানান, ভোট গ্রহণের দুই মাস আগে আনুষ্ঠানিকভাবে তপশিল ঘোষণা করবে ইসি। নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকলেও কমিশনের প্রস্তুতি এগিয়ে যাচ্ছে। কমিশনের প্রতি জনমনে আস্থা অর্জনকে বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। আগামী কয়েক মাসে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। আয়নার মতো স্বচ্ছ নির্বাচন উপহার দিতে চান বলেও জানান তিনি।
এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ওঠে। ফলে এই নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দল ও সাধারণ ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে বলে মনে করছেন ইসি কর্মকর্তারা। সিইসি বলেন, নির্বাচনকে আয়নার মতো পরিষ্কার করতে মিডিয়ার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এবারের নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে যেন কারও কোনো প্রশ্ন না থাকে, সে ব্যবস্থাই করা হবে।
কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন স্থগিত হওয়া আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কার্যক্রম তো নিষিদ্ধ। তবে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা ভোট দিতে পারবেন।’
ইসি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী ডিসেম্বরেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার লক্ষ্যে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জাতীয় নির্বাচনে সাধারণত তপশিল ঘোষণা থেকে ভোট গ্রহণের দিনের মধ্যে ৪৫ দিনের মতো সময় রাখা হয়। এবার কিছুটা সময় বেশি রাখা হতে পারে। এ জন্য অক্টোবরের মধ্যেই প্রস্তুতিমূলক সব কার্যক্রম গুটিয়ে আনাতে চাইছে তারা। তবে ভোটের তারিখ ঘোষণার আগে সার্বিক বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এক মাস ধরে সংলাপে বসার পরিকল্পনাও রয়েছে ইসির।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের চিঠি
জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের কথা উল্লেখ করে চিঠিতে আরও বলা হয়, বিগত ১৫ বছরে নাগরিকদের ভোট দিতে না পারার প্রেক্ষাপটে আগামী নির্বাচন যেন মহাআনন্দের ভোট উৎসবের দিন হিসেবে স্মরণীয় হয়, তেমন আয়োজনের ওপর প্রধান উপদেষ্টা জোর দিয়েছেন। চিঠিতে নির্বাচন আয়োজনে যথোপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহারের গুরুত্ব আরোপের পাশাপাশি একটি প্রত্যাশিত সুষ্ঠু, অবাধ, শান্তিপূর্ণ, উৎসবমুখর নির্বাচন আয়োজনে সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রত্যয়ের কথাও ইসিকে জানানো হয়।
অক্টোবরের মধ্যে শেষ হবে ইসির প্রস্তুতি
নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বিভিন্ন আইনবিধি ঠিক করার পাশাপাশি ভোটার তালিকা থেকে নির্বাচনী সরঞ্জাম কেনাকাটার কার্যক্রম চালাচ্ছে ইসি। সব কাজ অক্টোবরের মধ্যে গুছিয়ে আনতে চায় ইসি।
এদিকে মধ্য সেপ্টেম্বরে দেশে আসছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সাত সদস্যের প্রাক-নির্বাচনী প্রতিনিধি দল। যাদের মধ্যে তিনজন বিদেশি ও চারজন স্থানীয়। নির্বাচন-পূর্ব পরিবেশ পর্যবেক্ষণ এবং নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি ও পরিবেশ মূল্যায়ন করবেন তারা।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন এবং রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা চূড়ান্ত করতে আজ বৃহস্পতিবার ইসির বৈঠক ডাকা হয়েছে। আরপিওর সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত হবে। পরে অধ্যাদেশের জন্য সরকারের কাছে পাঠানো হবে।
ইসি সূত্র জানিয়েছে, আরপিওর সংশোধনীতে বিনা ভোটে বিজয় ঠেকাতে ‘না ভোট’ ফিরিয়ে আনা; জোটবদ্ধ হলেও দলীয় প্রতীকে ভোট করা; আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) আইনে অপরাধী সাব্যস্ত হলে প্রার্থী হতে না পারা; পুরো আসনের ভোট গ্রহণ বন্ধের ক্ষমতা ইসিকে ফিরিয়ে দেওয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞা পরিবর্তন করে সশস্ত্র বাহিনীর অন্তর্ভুক্তি এবং ভোট গ্রহণে ইসি ইভিএম পদ্ধতি বাদ রাখার প্রস্তাব থাকছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের অনেক সুপারিশ এতে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। পাশাপাশি আচরণবিধিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অপব্যবহার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা যুক্ত করা হচ্ছে।
ইসি এরই মধ্যে সীমানা আইন সংশোধন অধ্যাদেশ, ভোটার তালিকা সংশোধন অধ্যাদেশ, ভোটকেন্দ্র স্থাপন নীতিমালা (সংসদ ও স্থানীয় সরকার), স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থা নীতিমালা, বিদেশি পর্যবেক্ষক এবং গণমাধ্যম নীতিমালা জারি করেছে। পর্যবেক্ষক সংস্থার কাছ থেকে আবেদন আহ্বান করা হয়েছে। ১০ আগস্টের মধ্যে আবেদন পেলে বিধি অনুযায়ী শেষ করা হবে। নির্বাচনী ম্যানুয়াল দ্রুত শেষ করার পরিকল্পনা নিয়েছে ইসি।
এ ছাড়া নির্বাচনসংক্রান্ত আরও তিনটি আইন ও বিধি আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ উইংয়ে ভেটিংয়ের অপেক্ষায় রয়েছে। এগুলো হচ্ছে– নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা সংশোধন, নির্বাচন কর্মকর্তা বিশেষ বিধান সংশোধন এবং ইসি সচিবালয় আইন। ভেটিং শেষে এগুলো উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থাপন করা হবে।
ভোটার তালিকা ও প্রবাসী ভোটার
২ মার্চ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছিল ইসি, যেখানে ১২ কোটি ৩৭ লাখেরও বেশি ভোটার রয়েছে। আর ১০ আগস্ট বাদ পড়া সাড়ে ৪৪ লাখের মতো ভোটারের খসড়া তালিকা প্রকাশ ও মৃত ভোটারদের বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। খসড়া ভোটার তালিকার ওপর দাবি-আপত্তির নিষ্পত্তি ৩১ আগস্টের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া সংশোধিত আইন অনুযায়ী, নতুনদের ভোটার করতে ভোটের এক মাস আগে সর্বশেষ সম্পূরক তালিকা প্রকাশ হবে। সব মিলিয়ে হালনাগাদ ভোটার তালিকায় পৌনে ১৩ কোটি ভোটার হতে পারে বলে ধারণা ইসি কর্মকর্তাদের।
এবার প্রথমবারের মতো প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে সরকার ও ইসি অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে তাদের ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দিতে ইসি একটি নতুন প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছে। এ জন্য প্রায় ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে। শিগগির পরিকল্পনা কমিশনের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পাওয়া যাবে বলে ইসি আশা করছে।
ইসি সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত ৯টি দেশ থেকে ৪৮ হাজার ৮০ প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটার হতে আবেদন করেছেন। তাদের মধ্যে নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন ২৯ হাজার ৬৪৬ জন। ১৭ হাজার ৩৬৭ জন এরই মধ্যে ভোটার হয়েছেন।
সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ
ইতোমধ্যে ৩০০ সংসদীয় আসনের সীমানার খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। ১০ আগস্টের মধ্যে দাবি-আপত্তি জানানোর সময় রয়েছে। শুনানি শেষে এক মাসের মধ্যে এগুলো চূড়ান্ত হবে। ইসি কর্মকর্তাদের দাবি, অতীতের মতো এবার কোনো ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে নয়, বরং নিয়ম মেনে নির্বাচনী সীমানা নির্ধারণ করছেন তারা।
নির্বাচনী সরঞ্জাম কেনাকাটা
নির্বাচনী সরঞ্জাম কেনাকাটার কাজ ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ করতে চায় ইসি। ভোট গ্রহণের সরঞ্জাম হিসেবে সুঁই-সুতা, মোমবাতিসহ আটটি আইটেম এ সময়ের মধ্যে পাওয়া যাবে বলে আশা করছে তারা। সারাদেশের আঞ্চলিক ও উপজেলা-থানা নির্বাচন অফিসগুলোতে থাকা স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ব্যবহার উপযোগী ও যাচাই-বাছাই করার কাজও চলমান রয়েছে। এ ছাড়া প্রায় আট লাখ নির্বাচনী কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও চলমান রয়েছে।
কর্মকর্তাদের বদলি
মাঠ প্রশাসনে গতি আনতে কর্মকর্তাদের বড় ধরনের রদবদল শুরু করেছে ইসি। এরই মধ্যে ১৭৪ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে, যাদের মধ্যে আঞ্চলিক এবং উপজেলা-থানা পর্যায়ের নির্বাচন কর্মকর্তারা রয়েছেন।
ইসি সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে মাঠ পর্যায়ের যেসব কর্মকর্তা একই উপজেলায় দায়িত্ব পালন করছিলেন, তাদের প্রথমে বদলি করা হচ্ছে, যাতে স্বজনপ্রীতি না করে আগামী নির্বাচনে সবাই নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। শুধু মাঠ পর্যায়ের পদগুলো নয়, আঞ্চলিক, জেলা, অতিরিক্ত জেলা এবং ইসি সচিবালয়ের সব পর্যায়ের উচ্চ পদগুলোতেও পরিবর্তন আনা হবে।
এ প্রসঙ্গে ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ সমকালকে বলেন, প্রায় ২০০ কর্মকর্তাকে বদলির পাশাপাশি যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তাদের ব্যাপারে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুন:








