
সংঘাতময় রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে করিডোর দেওয়ার জাতিসংঘের অনুরোধে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে এই করিডোরের নিরাপত্তাসহ মানবিক সহায়তা কাঙ্ক্ষিত জনগোষ্ঠীর কাছে কীভাবে পৌঁছাবে- সে বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়। বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশ বোঝাপড়া করবে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এ ধরনের করিডোর সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এম মুনিরুজ্জামান বলেন, করিডোর দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই রাজনৈতিক ঐকমত্য জরুরি। কারণ, এখানে নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা কীভাবে এই করিডোরটি দেব, সে বিষয়টি নিয়ে এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে কোনো আলোচনা হয়নি।
চলতি বছরের শুরুতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করেছিল জাতিসংঘ। এ জন্য যুদ্ধকবলিত রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে বাংলাদেশের কাছে জাতিসংঘ করিডোর চেয়ে অনুরোধ করে। সেই অনুরোধ রক্ষা করে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শর্তসাপেক্ষে মিয়ানমারের বেসামরিক লোকজনের জন্য করিডোর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, মার্চ মাসে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের ঢাকা সফরের সময়ে বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়। গুতেরেসের ঢাকা সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য করিডোর সুবিধা দিতে বাংলাদেশকে রাজি করানো। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ সময়ে ইতিবাচক অবস্থান তুলে ধরা হয়। ওই কর্মকর্তা আরো জানান, সম্প্রতি ঢাকা সফর করা মার্কিন উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলও বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান জানতে চেয়েছিল। মার্কিন কূটনৈতিক দলকেও বাংলাদেশের ইতিবাচক মনোভাবের কথা জানানো হয়েছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোর দেওয়ার বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘নীতিগতভাবে আমরা এতে সম্মত। কারণ, এটি একটি হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ হবে। কিন্তু আমাদের কিছু শর্তাবলি রয়েছে, সে বিষয়ে বিস্তারিততে যাচ্ছি না। সেসব শর্তাবলি যদি পালিত হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।’
করিডোর বাংলাদেশের জন্য নিরাপদ কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, মালপত্র যাওয়ার ব্যবস্থা; অস্ত্র নেওয়া হচ্ছে না।
এদিকে বাংলাদেশের শর্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, করিডোরের প্রস্তাবটি যেহেতু জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এসেছে, তাই যাবতীয় বিষয় জাতিসংঘের সঙ্গে বোঝাপড়া করবে বাংলাদেশ। এখানে মিয়ানমারের জান্তা সরকার অথবা আরাকান আর্মির সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করবে না। বাংলাদেশ জাতিসংঘের কাছে নিশ্চিত হতে চায় নিজেদের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে যে মানবিক সহায়তা যাবে, তা যেন কাঙ্ক্ষিত জনগোষ্ঠী অর্থাৎ যাদের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন, তারাই শুধু পাবে। কোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে এসব মানবিক সহায়তা যেন না যায়। এ ছাড়া আরাকান রাজ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও জাতিসংঘের জোরালো ভূমিকা দেখতে চায় বাংলাদেশ। আরাকান রাজ্যের স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি।
অতীতে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে আরাকান রাজ্যে মানবিক সহায়তা পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে ইউনিসেফ এবং ইউএনডিপির মাধ্যমে ওষুধসহ বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জাম বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে আরাকান রাজ্যে পাঠানো হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে প্রথমদিকে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি জানানো হয়নি। তবে গত বছরের মাঝামাঝি ইউএনডিপির মাধ্যমে মানবিক সহায়তার বিরাট একটি চালান আটকে দেয় জান্তা সরকার। এরপর থেকে আর কোনো সহায়তা পাঠানো সম্ভব হয়নি।
সম্প্রতি জাতিসংঘ বাংলাদেশকে জানায়, রাখাইনের পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এর ফলে রাজ্যটিতে ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা রয়েছে। জাতিসংঘ জানায়, রাখাইনের দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করা না গেলে এবার শুধু রোহিঙ্গা নয়, সেখানে বসবাসরত বাকি জনগোষ্ঠীও সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। তাই সেখানকার দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় করিডোর দিয়ে বাংলাদেশের সহযোগিতা চাইছে জাতিসংঘ।
গত বছরের অক্টোবরে ইউএনডিপি রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনে রাখাইনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতির কথা উল্লেখ করা হয়। রাখাইনে পণ্য প্রবেশের জন্য আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ সীমান্ত বন্ধ রয়েছে। সেখানকার বাসিন্দাদের আয়ের কোনো উৎস নেই। এর ফলে ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি, অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদনে ধস, জরুরি সেবা ও সামাজিক সুরক্ষায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সেখানে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর পরিস্থিতি আরো অবনতির আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্চ অথবা এপ্রিল মাসের মধ্যে রাখাইন রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মানবিক সহায়তা পাঠাতে করিডোর সুবিধা দিতে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ।
উল্লেখ্য, রাখাইন অঞ্চলটি বিশ্বে মাদক, অবৈধ অস্ত্র পাচারসহ নানা আন্তঃসীমান্ত অপরাধের অন্যতম রুট হিসেবে পরিচিত। করিডোর দিলে মাদক বা অবৈধ অস্ত্র বাংলাদেশে প্রবেশের আশঙ্কা তৈরি হবে। এ ছাড়া রাখাইনে বর্তমানে কোনো স্বীকৃত প্রশাসন নেই। ফলে সেখানকার অস্বীকৃতদের সঙ্গে কোনো ধরনের দরকষাকষির আলাদা ঝুঁকি রয়েছে।
করিডোর দেওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়ে মেজর জেনারেল (অব.) এম মুনিরুজ্জামান বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমরা স্পষ্ট কোনো ধারণা এখনো পাইনি। এই করিডোরের ধরন কী হবে, এর রূপ কী হবে, অর্থাৎ কোন স্থান থেকে কোন স্থানে সাহায্য যাবে, তা এখনো কেউ জানে না। এখানে নিরাপত্তার বিষয়টি কীভাবে নিশ্চিত করা হবে- সেটাও স্পষ্ট নয়। এগুলো সরকারকে স্পষ্ট করতে হবে।
এম মুনিরুজ্জামান আরো বলেন, রাখাইন রাজ্যে সংঘাতে লিপ্ত মিয়ানমার জান্তা ও আরাকান আর্মির সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ হয়েছে কি না, তা কেউ জানে না। সংঘাতে লিপ্ত মিয়ানমান জান্তা ও আরাকান আর্মির মধ্যে এই করিডোরের ব্যাপারে একটা বোঝাপড়া বা উভয়ের সম্মতি থাকতে হবে। যেমন, গাজায় মানবিক সহায়তা পাঠানোর ব্যাপারে হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা ছিল। এ ক্ষেত্রে এ ধরনের বোঝাপড়া দরকার।
নিরাপত্তা ঝুঁকির প্রসঙ্গ তুলে ধরে এম মুনিরুজ্জামান বলেন, সংঘাতময় কোনো দেশের সঙ্গে যুক্ত হলে অবশ্যই নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হবে। সুতরাং করিডোর দেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা-পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে। সার্বিক দিক বিবেচনা না করে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে একবার ঢুকে গেলে তা থেকে বেরিয়ে আসা অত্যন্ত কঠিন হবে। আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তা পাঠানোর জন্য পাকিস্তান এ ধরনের করিডোর সুবিধা দিয়ে আজও বিপদের মধ্যে আছে। এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ও নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত ইস্যুতে অবশ্যই রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে
আরও পড়ুন: