রবিবার

২৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১৩ পৌষ, ১৪৩২

উখিয়া-টেকনাফে মানুষের পিছু ছাড়ছেনা অজ্ঞাত রোগ

কক্সবাজার

প্রকাশিত: ৩১ জুলাই, ২০২৫ ১৩:৪৭

আপডেট: ৩১ জুলাই, ২০২৫ ১৩:৪৮

শেয়ার

উখিয়া-টেকনাফে মানুষের পিছু ছাড়ছেনা অজ্ঞাত রোগ
ছবি সংগৃহীত

উখিয়া-টেকনাফের ঘরে ঘরে এখন ছড়িয়ে পড়া অজানা ভাইরাস। ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়া রোগটিকে নেটিজেনরা বলছেন অজানা ভাইরাস। স্থানীয় গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের ভাষায় ‘লুলা ব্যারাম’। তবে লক্ষণগুলো মিলে যাচ্ছে অনেকটা এডিস মশা বাহিত চিকনগুনিয়ার সাথে। চিকিৎসকগণ হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসা নিয়ে।

উখিয়া-টেকনাফের ঘরে ঘরে আক্রান্ত সর্ববয়সী মানুষ। হাসপাতাল ও ফার্মেসিগুলোতে ভীড় লেগেই আছে। কর্মক্ষম হয়ে পড়ছে খেটে খাওয়া মানুষ। কিন্ত মাসাধিককাল ধরে এটা ছড়াতে থাকলেও স্বাস্থ্য বিভাগ এখনও পর্যন্ত এই রোগ নির্ণয় করে জনসাধারণকে অবগত করতে পারেননি রোগটা আসলে কি এবং প্রতিকার ও প্রতিরোধের উপায় কি। দেশে বিশেষ করে উখিয়া-টেকনাফে ছড়িয়ে পড়া অজানা ভাইরাসটির নাম এখনো পর্যন্ত শনাক্ত করা হয়নি। তবে শনাক্তকরণের জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে।

টেকনাফ-উখিয়া জুড়ে ঘরে ঘরে এই অজ্ঞাত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। প্রায় বাড়ী-ঘরে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন। উপজেলা থেকে জেলা ও শহরের হাসপাতাল সমূহে আক্রান্ত রোগীরা আরোগ্য লাভের আশায় ছুটছেন। কিন্তু চিকিৎসা গ্রহণের কিছুদিন যেতে না যেতেই আবারো একই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে আক্রান্ত রোগী এবং তাদের স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা গেছে।

স্বাস্থ্য সচেতন লোকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, রোগটি একটি ভাইরাস জনিত রোগ। এই রোগ হলে আক্রান্ত ব্যক্তির পানি শুন্যতা দেখা দেয়। সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা অনূভব করে। মাত্রাতিরিক্ত জ্বরের পাশাপাশি হাঁড় ও বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যাথা দেখা দেয়। এসময় অনেকের পা ফুলে যায়। মুখের রুচি নষ্ট হয়ে বমি বমি ভাব দেখা দেয়। আক্রান্ত রোগীর ঘুম হয়না। পুরো শরীর দুবর্ল হয়ে পড়ে। এসময় অনেক রোগীর মধ্যে এলার্জির লক্ষণও দেখা যায়।

চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য মতে, গত মে-জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে উখিয়-টেকনাফে এই রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। অনেকটা চিকনগুনিয়ার মত হলেও পরীক্ষা করে দেখা গেছে ৮০% চিকনগুনিয়ার লক্ষণ পাওয়া গেছে।

বিভিন্ন এলাকার লোকজনের দেওয়া তথ্য মতে, উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার আশেপাশে এই রোগ বেশী ছড়িয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং তৎসংশ্লিষ্ট এলাকায় এমন কোন ঘর নেই যে ঘরে কম বেশী সকলে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। জ্বর এবং ব্যথায় ছোট-বড় সকলে কাবু হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে এই রোগে আক্রান্ত শিশু এবং বৃদ্ধ বয়সের লোকজন বেশী দুর্বল হয়ে পড়েন। শরীরে পানি শুন্যতা দেখা দেওয়ার সাথে সাথে শিশু এবং বৃদ্ধ বয়সের লোকেরা একেবারেই দুর্বল হয়ে পড়ছেন।

আক্রান্ত স্থানীয় সংবাদকর্মী ফরিদুল আলম বলেন, মাত্রাতিরিক্ত জ্বর ও জয়েন্টে প্রচন্ড দেখা দিলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হই। চিকিৎসকের পরামর্শে ঔষুধ সেবনের কিছুদিন পর আবারো একই রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ি। বর্তমানে জ্বর না থাকলেও এখনো ব্যথা নিয়ে কষ্টের মধ্যে আছে বলে জানান।

লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্প ম্যানেজম্যান্ট কমিটির চেয়ারম্যান মো. আলম জানান, ক্যাম্পে এমন কোন ঘর বাকী নেই। যে ঘরের কমবেশী সকলে ‘লুলা ব্যারাম’ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন। চিকিৎসা নেওয়ার সপ্তাহ খানিক পর আবারো একই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

হেলথ্ এসিস্ট্যান্ড ও লাইফ স্টাইল মেডিসিনে অভিজ্ঞ ডাক্তার মো. রশিদ আল মামুন জানান, রাতে এবং দিনে মশারী টাঙ্গিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস করতে হবে। বসতভিটা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন এবং খাবারে হাইজিন মেইনটেইনের উপর গুরুত্বারোপ করা উচিৎ। পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে জনবহুল স্থানে মাস্ক পরা দরকার। এছাড়া রাত না জেগে সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়ারও পরামর্শ দিয়েছেন অভিজ্ঞ এই চিকিৎসক।

টেকনাফ উপজেলা কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. এনামুল হক জানান, প্রতিদিন শত শত জ্বরের রুগী হাসপাতালে আসছে। পরিক্ষা করলেও রোগ শনাক্ত করা যাচ্ছেনা।

টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. প্রণয় রুদ্র জানান, গত কুরবানীর ঈদের সময়ে টেকনাফে আচমকা এই রোগ দেখা দেয়। জুন মাসে ঢাকা থেকে একটা টীম এসে ২০ জনের স্যাম্পল নেন। প্রদত্ত স্যাম্পল পরীক্ষা করে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। এতে আতংকিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষুধ সেবন করলে ৭/৮দিন পর এই রোগ ভাল হয়ে যাবে। তাছাড়া ইতিমধ্যে রোগটি শনাক্তকরণে বা নাম নির্ণয়ে স্যাম্পল সংগ্রহ করে ঢাকা গবেষণাগারে পাঠানো হয়েছে এবং বাংলাদেশেও অতিশীঘ্রই এই ভাইরাসের নাম শনাক্ত করা হবে।

কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক সংক্রামণ রোগ ও ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. শাহজাহান নাজির জানান, আইসিডিডিআরবিতে কক্সবাজার থেকে ২শ স্যাম্পল পাঠানো হয়েছিল। প্রদত্ত স্যাম্পল পরীক্ষা এবং বিশ্লেষণে ৮২% চিকনগুনিয়ার লক্ষণ পাওয়া যায়। তাই এটি চিকনগুনিয়া জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আতংকিত না হয়ে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া তিনি প্রচুর পরিমাণে পানি পান এবং প্রয়োজন মতো প্যারাসিটামল সেবনের পরামর্শ দিয়েছেন। চার ধরনের জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। বর্তমানে সর্ববয়সী মানুষের বিশেষত. রোহিঙ্গাদের মাঝে জ্বরের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। এই জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে উচ্চমাত্রার জ্বর, অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা, কখনো ফুলে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। অনেক সময় জ্বর সেরে গেলেও কয়েক সপ্তাহ বা মাসব্যাপী জয়েন্টের ব্যথা থেকে যাচ্ছে। বর্তমানে চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, সাধারণ ভাইরাস জ্বর (ফ্লু) ও করোনা ভাইরাসজনিত জ্বর এই চারটি জ্বরের প্রকোপ রয়েছে। প্রায় প্রতিটি এলাকায় রয়েছে জ্বরের রোগী। জ্বরের সঙ্গে জয়েন্টে ব্যথা, হাড় ফুলে যাওয়া, র‌্যাশ এসব উপসর্গ থাকলে চিকুনগুনিয়ার আশঙ্কা বেশি। মূলত এই ভাইরাসটির উৎপত্তি থাইল্যান্ড, মালেশিয়া ও মিয়ানমারে। মিয়ানমার এই ভাইরাসটি ‘আলফা ওয়ান’ নামে শনাক্ত করা হয়েছে।



banner close
banner close