
বিগত বছরগুলোতে দেশের স্বাস্থ্যখাতের অগ্রগতি শ্লথ হয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরোপুরি থেমে গেছে কিংবা পশ্চাদমুখী হয়েছে। ফলে প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার লক্ষ্য অর্জন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ এখনো একটি ন্যায্য মানব ও টেকসই স্বাস্থ্যব্যবস্থা গঠনের পথে দৃশ্যমান বাধাগুলোকে কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
জাতীয় অধ্যাপক একে আজাদ খানের নেতৃত্বে গঠিত ১২ সদস্যের স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে এমন মন্তব্য করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনটি সোমবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেন কমিশনের সদস্যরা।
সংস্কার কমিশন প্রতিবেদনের ভূমিকায় বলা হয়েছে, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসারসহ অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি, মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি, জরুরি চিকিৎসা ও মানসম্মত সেবার অপ্রতুলতা, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে ব্যক্তি-পর্যায়ে খরচ জনগণের ওপর তীব্র চাপ তৈরি করছে। পাশাপাশি দুর্নীতি, সক্ষমতার ঘাটতি, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং চিকিৎসা শিক্ষায় নিম্নমান ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুতর হুমকি হয়ে উঠে এসেছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ স্বাস্থ্যখাতে আজও এক জটিল বাস্তবতার মুখোমুখি।
অবশ্য প্রতিবেদনে ভূমিকার শুরুতেই বলা হয়, স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে অনেক প্রশংসনীয় অগ্রগতি হয়েছে। মূলত টিকাদান, পুষ্টি, মা-শিশু স্বাস্থ্য, সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। একই সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা ইত্যাদি সহায়ক কর্মসূচির মাধ্যমে স্বাস্থ্যক্ষেত্রের বিভিন্ন সূচকে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।
অন্যদিকে দেশের সংবিধান এবং বিভিন্ন জাতীয় নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার অনুসারে (বিশেষত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি) সব নাগরিকের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা দিতে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।
সরকার গঠনের পর দেশকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে বিভিন্ন খাতে সংস্কার কমিশন গঠিত হয়। এর মধ্যে স্বাস্থ্যখাতকে জনমুখী, সহজলভ্য ও সর্বজনীন করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার ১৮ নভেম্বর স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন গঠন করে। ৩ ডিসেম্বর থেকে কমিশন কার্যক্রম শুরু করে।
প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর ৫ মে বিকেলে রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের প্রধান জাতীয় অধ্যাপক ডা. একে আজাদ খান জানান, স্বাস্থ্যখাতকে জনমুখী, সহজলভ্য ও সর্বজনীন করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য কমিশন মোট সাতটি বিষয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করে।
১. একটি ন্যায্য ও অধিকার-নির্ভর সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলা
২. প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো ও জনবল শক্তিশালী করা
৩. জরুরি চিকিৎসা সেবার উন্নয়ন
৪. স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সুশাসন, আর্থিক স্বচ্ছতা ও দুর্নীতির প্রতি শূন্য সহনশীলতা নীতি প্রবর্তন
৫. মানসম্পন্ন চিকিৎসা শিক্ষা ও প্রযুক্তিনির্ভর চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধি
৬. জনসাধারণের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সন্তুষ্টি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।
৭. স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে ব্যক্তি পর্যায়ের ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে নিয়ে আসা।
তিনি জানান, এ প্রতিবেদন তৈরির কাজটি একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয় ছিল, যেখানে দীর্ঘদিনের দুর্নীতি, অনিয়ম, পক্ষপাত, রাজনীতি প্রভাবিত কর্মকাণ্ড, অযোগ্য লোকদের নিয়োগ এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিসংখ্যান ও বিকৃত তথ্য পুরো স্বাস্থ্যখাতের ক্ষতি করেছে। এসব চ্যালেঞ্জিং দিক তথ্য সংগ্রহে বড় বাধা সৃষ্টি করেছে। প্রচলিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কমিশন তথ্য সংগ্রহের ও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছে।
যে পদ্ধতিতে সংস্কার প্রতিবেদন সম্পন্ন হয়
এ প্রতিবেদন প্রণয়নে একটি বহুমাত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়; যেখানে তথ্য-প্রমাণভিত্তিক বিশ্লেষণ, অংশীজনের মতামত এবং নীতিনির্ধারণে প্রাসঙ্গিক তথ্যসমূহ বিবেচনায় নেওয়া হয়। একটি বহুমাত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতির মাধ্যমে এই প্রতিবেদন প্রণয়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।
এক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণী প্রাসঙ্গিক বিবিধ তথ্য-উপাত্ত, অংশীজনের মতামত, জরিপ থেকে প্রাপ্ত জনমত এবং সরেজমিন পরিদর্শনে প্রাপ্ত তথ্য ও মতামত বিবেচনায় নেওয়া হয়।
১. প্রকাশনা পর্যালোচনা
প্রাসঙ্গিক নীতিমালা, আইন, গবেষণা প্রতিবেদন এবং পরিকল্পনাগুলোর ভিত্তিতে প্রকাশনা পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে জাতীয় সব নীতি, সেক্টর পরিকল্পনা, কৌশলপত্র, গাইডলাইন, সার্ভে ইত্যাদি। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের এবং শিক্ষাবিদ-গবেষকদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত প্রাসঙ্গিক সব প্রকাশনাও এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এছাড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সফলতা অর্জনকারী দেশ যেমন থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, ভারত, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, রুয়ান্ডা, ভিয়েতনাম ও কিউবার স্বাস্থ্যনীতি ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত গবেষণা ও নীতিমালা বিশ্লেষণ করা হয়। এই বিশ্লেষণ স্বাস্থ্য খাতে বৈশ্বিক ও স্থানীয় বাস্তবতা মিলিয়ে প্রাসঙ্গিক, প্রয়োগ যোগ্য ও প্রমাণভিত্তিক সুপারিশ প্রণয়নে সহায়ক হয়।
২. কমিশনের কার্যালয়ে অংশীজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ আলোচনা
কমিশন থেকে পরিকল্পিত একটি তালিকা অনুসারে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে নির্দিষ্ট দিনক্ষণের কমিশন সাক্ষাৎ আলোচনা করে। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নীতিমালা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, শিক্ষাদান গবেষণা সামাজিক আন্দোলন ও সাংবাদিকতা ইত্যাদি নানাবিধ কর্মকাণ্ডে সব প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ের অংশীজনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
৩. কমিশন থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন
নিজস্ব কার্যালয়ে সাক্ষাৎ মতবিনিময় ছাড়াও কমিশন দেশের বিভিন্ন স্থানে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় ও পরামর্শ সভার আয়োজন করে।
৪. তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, জাতীয় স্বাস্থ্য হিসাব এবং অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে। অসংক্রামক রোগ, মাতৃমৃত্যু, শিশুস্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য ব্যয় এবং স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণে ব্যক্তি পর্যায়ের ব্যয়ের হার বিষয়ে বিশ্লেষণে অন্তর্ভুক্ত হয়।
৫. সরেজমিনে পরিদর্শন ও মতবিনিময়
কার্যালয় ও নির্দিষ্ট স্থানে আলোচনা ছাড়াও কমিশন সংশ্লিষ্ট বিবিধ প্রতিষ্ঠান ও বা পরিদর্শনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করে। পরিদর্শনকালে চিকিৎসক-নার্স ছাড়াও বিবিধ পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের সঙ্গে একক ও যৌথ মতবিনিময়ের ব্যবস্থা করা হয় এবং সেই সঙ্গে সেবা গ্রহণকারীদের মতামত গ্রহণ করা হয়। স্থান ও প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের সময় দুর্গম এলাকা ও অবহেলিত ডিসিপ্লিনগুলোর ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দেওয়া হয়।
৬. জনমত জরিপ
স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের অনুরোধে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) একটি জনমত জরিপ পরিচালনা করে। সুপারিশ প্রণয়নে এই জরিপের ফলাফল গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হয়।
জনমত জরিপটি পরিচালনার লক্ষ্যে সমগ্র দেশের আটটি বিভাগ (শহর ও পল্লী এলাকা) থেকে প্রায় ৩৪৪টি প্রাথমিক নমুনা (শুমারি গণনা এলাকা) নির্বাচন করা হয়।
জরিপ পরিচালনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিটি নমুনা এলাকা থেকে নমুনায়নের ২৪টি সাধারণ থানা নির্বাচন করা হয়। নির্বাচিত প্রতিটি থানা থেকে ১৮ বা তদূর্ধ্ব বয়সী একজনের হাত থেকে নির্ধারিত মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এভাবে দেশব্যাপী প্রায় ৮ হাজার ২৫৬ জন নাগরিকের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ পূর্বক জরিপের বিশ্লেষণসহ রিপোর্ট প্রণয়নের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। জরিপের তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রমে জনশুমারি ও গৃহ গণনা ২০২২ এর ভিত্তিতে প্রণীত ইন্টিগ্রেটেড মাল্টিপারপাস স্যাম্পলিং (আইএমপিএস) ব্যবহার করা হয়।
থানাভিত্তিক জরিপের প্রশ্নপত্রটি চারটি সেকশনে বিভক্ত করা হয়
সেকশন ১. থানা সদস্যদের তালিকা ও পরিচিতি, সেকশন ২. জনগণের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি বিষয়ের অভিজ্ঞতা, সেকশন ৩. জনগণের সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি বিষয়ে মতামত এবং সেকশন ৪. নীতি নির্ধারণ বিষয়ে প্রশ্ন।
সংবাদ সম্মেলনে জনমত জরিপ থেকে প্রাপ্ত মূল মতামত সমূহ তুলে ধরা হয়। মতামতগুলো নিম্নরূপ
১. ৯৭ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে দেওয়া প্রয়োজন।
২. ওষুধের মূল্য, রোগ নির্ণায়ক পরীক্ষার মূল্য ও চিকিৎসকের পরামর্শ ফি বা অস্ত্রোপচারের ফি নির্দিষ্ট করার পক্ষে মত দিয়েছেন যথাক্রমে ৯৭ শতাংশ ৯৬ শতাংশ, ৯৬ শতাংশ ও ৯৫ শতাংশ উত্তর দাতা।
৩. শহর অঞ্চলের ওয়ার্ডগুলোতে গ্রামীণ ইউনিয়ন পর্যায়ের মতো প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র তৈরি করার পক্ষে ৯২ শতাংশ উত্তরদাতা মত দিয়েছেন।
৪. চিকিৎসা, স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং রোগ প্রতিরোধ কার্যক্রম তথা জনস্বাস্থ্য সেবা পৃথক অবকাঠামোর মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া উচিত, এ বিষয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিয়েছেন ৭২ শতাংশ উত্তর দাতা। সহায়ক পদে কর্মরতদের বদলির পক্ষে মত দিয়েছেন ৭৬ শতাংশ উত্তর দাতা।
৬৮ শতাংশ উত্তর দাতা এমবিবিএস চিকিৎসক ছাড়া অন্য কারো প্রেসক্রিপশনে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি না করার পক্ষে মত দিয়েছেন; স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ের বেশির ভাগের দায়িত্ব থাকা উচিত সরকারের এই মত ৯২ শতাংশ উত্তর প্রদানকারীর।
স্বাস্থ্যহানিকর খাদ্য, পানীয় ও ভোগ্যপণ্যের ওপর উচ্চহারে কর প্রয়োগ করা উচিত এই বিষয়ে একমত ৭৯ শতাংশ উত্তরদাতা। স্বাস্থ্যবিমা গ্রহণে আগ্রহী ৭১ শতাংশ উত্তরদাতা।
স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালিত একই ধরনের সেবাক্রম একীভূত করা উচিত বলে মনে করেন ৬৭ শতাংশ উত্তরদাতা।
আরও পড়ুন: