সোমবার

২২ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৭ পৌষ, ১৪৩২

ড্যাপ লঙ্ঘন ও দুর্নীতির অভিযোগ সিডিএর সাবেক অথরাইজড অফিসার ইলিয়াসের বিরুদ্ধে

সিটি প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ২২ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১১:১৫

আপডেট: ২২ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১১:২১

শেয়ার

ড্যাপ লঙ্ঘন ও দুর্নীতির অভিযোগ সিডিএর সাবেক অথরাইজড অফিসার ইলিয়াসের বিরুদ্ধে
সিডিএর সাবেক অথরাইজড অফিসার ইলিয়াস

মোহাম্মদ ইলিয়াস ২০০৬ সালের ২০ মার্চ সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে সিডিএতে যোগ দেন। ২০১৯ সালের অক্টোবরে অতিরিক্ত দায়িত্বে অথরাইজড অফিসারের পদ লাভ করেন এবং ৭ নভেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গভাবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর থেকেই তার সম্পদের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়। অভিযোগ রয়েছে, এ সময় থেকে তিনি নির্মাণ অনুমোদনের ক্ষমতা অপব্যবহার করে ছোট জমিতে বড় ভবনের অনিয়মিত অনুমতি দিয়ে কোটি কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণ করেন এবং সেই অর্থ বিদেশে পাচার করে পরবর্তীতে আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আকারে দেশে এনে বিভিন্ন স্থানে সম্পত্তি ক্রয় করেন।

সংরক্ষিত পাহাড় ও ড্যাপ লঙ্ঘন করে অনুমোদন :

নগরীর জামালখান আসকার দীঘির পাড়ের সংরক্ষিত পাহাড়ের ঢালের রেকর্ড পরিবর্তন করে ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) উপেক্ষা করে নির্মাণ অনুমোদন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ইলিয়াসের বিরুদ্ধে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পরিবেশগত ছাড়পত্র নেয়ার আগেই তিনি ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল পাহাড় কেটে তার চূড়ায় ১৪ তলা আবাসিক ভবন নির্মাণের অনুমতি দেন; এই প্রকল্পের নির্মাণ অনুমোদন নম্বর ২৫.৪৭.১৫০০.০৭৩.৪৩.১৭০.২৩। নগর উন্নয়ন ও পরিবেশ সুরক্ষা নীতিমালার পরিপন্থী এই অনুমতিকে সংশ্লিষ্ট মহল সরাসরি ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবে দেখছেন।

আগ্রাবাদ বাদামতলী দাল্লা মেডিকেলের পিছনে অবস্থিত ‘মুনতাসির বিল্ডিং লিমিটেড’-কে অবৈধভাবে ২০ তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেন সিডিএর সাবেক অথরাইজড অফিসার মোহাম্মদ ইলিয়াস। ২০২৩ সালের প্রদত্ত এই নির্মাণ অনুমোদনের নম্বর ছিল ২৫.৪৭.১৫০০.০৭৩.৪৩.১৯১.২৩। ভবনটির জন্য স্বত্বভুক্ত কোনো প্রবেশপথ না থাকা সত্ত্বেও তিনি অনুমোদন দেন এবং গণপূর্ত অধিদপ্তরের জমিকে ব্যক্তিমালিকানা হিসেবে দেখিয়ে গণপূর্তের কোনো অনুমতি ছাড়াই অনুমোদন সম্পন্ন করেন। অভিযোগ রয়েছে, এই অনুমোদনের বিপরীতে তিনি কোটি টাকার বিনিময়ে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেছেন।

বিসি কেইস নম্বর ৭২২/২০২০–২০২১–এর মাধ্যমে নুরুল মোস্তফা নামে এক ব্যক্তি দক্ষিণ কাট্টলী মৌজায় সরকারি জমিকে নিজের মালিকানা দাবি করে সিডিএতে নকশা অনুমোদনের আবেদন করেন। সংশ্লিষ্ট খতিয়ান (খতিয়ান নং ৬০৭৬, বিএস দাগ নং ১২৭২০) যাচাইয়ের জন্য এএসি (ল্যান্ড) কার্যালয়ে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়ে তৎকালীন ইমারত পরিদর্শক স্বপন নথিতে আপত্তি জানান। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, পরবর্তীতে মোহাম্মদ ইলিয়াস দুর্নীতির মাধ্যমে জাল বি.এস খতিয়ান (খতিয়ান নং ১৪৭৯/১, বিএস দাগ নং ৬৮৪৩ ও ৬৮৪৪) তৈরি করে আরেক ইমারত পরিদর্শক মো. আবু জাফর ইকবালকে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে ওই ভুয়া খতিয়ানের ভিত্তিতেই বেইসমেন্টসহ ১৩ তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেন।

একজন পূর্ণকালীন সরকারি কর্মকর্তা হয়েও মোহাম্মদ ইলিয়াস দীর্ঘদিন ধরে হালিশহর এসি মসজিদ ‘ডিজাইন ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি কনসালটিং প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন, যা ভবন নকশা ও নির্মাণসংক্রান্ত পরামর্শ ও সেবা দিয়ে থাকে। অথরাইজড অফিসার হিসেবে যে দপ্তরে তিনি নকশা অনুমোদনের মূল দায়িত্বে ছিলেন, একই খাতে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করাকে স্পষ্ট স্বার্থের সংঘাত হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। অভিযোগ রয়েছে, এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যারা সিডিএতে নকশা অনুমোদনের আবেদন করতেন, বিশেষ করে হালিশহর এলাকায় ছোট জমিতে বড় ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে তারা সহজে অনুমোদন পেতেন, যা প্রাতিষ্ঠানিক ন্যায়বিচার ও নীতিমালা উভয়কেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

অবৈধ অর্থ পাচারের কৌশল

ইটালি ও আমেরিকায় বসবাসকারী আত্মীয়-স্বজনের সুযোগ নিয়ে মোহাম্মদ ইলিয়াস প্রথমে অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তীতে সেই অর্থ আত্মীয়দের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আকারে দেশে ফিরিয়ে এনে সম্পত্তি ক্রয় করে। এই কৌশলের মাধ্যমে অবৈধ অর্থের মূল উৎস গোপন করাই ছিল প্রধান লক্ষ্য।

একাধিক ভবনের মালিকানা

পূর্বে শ্বশুরের শাহী ভবন (#২০, রোড-১, সোনালী আবাসিক এলাকা) বসবাস করলেও পরবর্তীকালে তিনি একই এলাকায় নিজের মায়ের নামে ‘ফাতেমা মঞ্জিল’ (#৪৫, রোড-১) এবং শাশুড়ির নামে ‘রোকসানা মঞ্জিল’ (#৪৭, রোড-১) নামে পাশাপাশি দুটি সাততলা ভবন নির্মাণ করেছেন। মালিকানা যদিও মা ও শাশুড়ির নামে রয়েছে, তবে মূল মালিকানা হিসেবে মোহাম্মদ ইলিয়াসকেই জানে এলাকাবাসী।

জমি ক্রয় ও পরিবেশগত অপরাধ

চট্টগ্রাম শহরের আকবর শাহ থানার ৯ নং ওয়ার্ডের লেক সিটি আবাসিক এলাকায় একাধিক প্লট ক্রয় করেছেন তিনি। এর মধ্যে শাশুড়ি রোকসানা বেগমের নামে ক্রয়কৃত জমি (বি.এস দাগ নং ১৭৯, ১৮০) টিলা শ্রেণির পাহাড় কাটার অভিযোগে গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০)-এর ধারা ৬(খ) লঙ্ঘনের দায়ে তাঁর শাশুড়ির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য তিনি ঘ-১১-২৬৮৮ নম্বরের একটি নিশান এক্সট্রেইল গাড়িও ব্যবহার করেন তিনি।

তবে ইলিয়াছের দাবি, অথরাইজড অফিসার থাকাকালীন দেড় হাজারের বেশি ভবন অনুমোদন দিয়েছেন এবং কোনো নিয়ম ভঙ্গ করেননি। আত্মীয়রা বিদেশে বসবাস করায় তারাই এই সম্পত্তিগুলো ক্রয় করেছেন। তিনি এই সম্পত্তির মালিক নন।

চাকরির টাকায় চলা যায় না বলে বিকেল পাঁচটার পর তিনি এক বন্ধুর কনসালটিং ফার্মে সময় দেন, যা তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী মানুষের উপকারের জন্য।

সরকারি কর্মচারী আচরণবিধি লঙ্ঘন

সরকারি পদে থেকে নিজস্ব বা ঘনিষ্ঠজনের কনসালটিং ফার্মে জড়িত থাকা এবং পদের প্রভাব ব্যবহার করে ব্যবসায়িক সুবিধা নেয়া সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর ১৭ ও ৩১ নম্বর বিধি অনুযায়ী নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য আচরণ হিসেবে বিবেচিত।

আইনের দৃষ্টিতে সরকারি কর্মকর্তার অপরাধ ও শাস্তি

দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণ সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে আর্থিক সুবিধা নেয়ার অভিযোগ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারা এবং দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ১৬১ ও ১৬৫ ধারার আওতায় অপরাধমূলক অসদাচরণ হিসেবে বিবেচিত। জালিয়াতি ও বিশ্বাসভঙ্গভুয়া খতিয়ান, সরকারি জমি আত্মসাৎ ও কাগজপত্র জালিয়াতি প্রমাণিত হলে দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১ ও ৪০৯ ধারায় দলিল জালিয়াতি ও সরকারি কর্মচারীর বিশ্বাসভঙ্গের গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য।

পরিবেশ ও নগর পরিকল্পনা আইন লঙ্ঘন

পাহাড় কেটে প্লট ও ভবন নির্মাণের অভিযোগ বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর ৬(খ) ধারায় নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ডের মধ্যে পড়ে, আর ড্যাপ ও নগর পরিকল্পনা বিধিমালা অমান্য করে নির্মাণ ইমারত নির্মাণ আইন, ১৯৫২ ও সংশ্লিষ্ট বিধিমালা লঙ্ঘনের শামিল।



banner close
banner close