সোমবার

১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১ পৌষ, ১৪৩২

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ; এখনো সক্রিয় আওয়ামী লীগ–ঘনিষ্ঠ সিন্ডিকেট

সিটি প্রতিনিধি,চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১০:৫৯

আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১১:১১

শেয়ার

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ; এখনো সক্রিয় আওয়ামী লীগ–ঘনিষ্ঠ সিন্ডিকেট
ফাইল ছবি

৫ই আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রের অনেক প্রতিষ্ঠানে সংস্কারের ছোঁয়া লাগলেও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। গত ১৫ বছরে গড়ে ওঠা দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট এখনো বহাল তবিয়তে রাজত্ব করছে। অভিযোগ উঠেছে, ফাইল গায়েব, ভুয়া স্লিপে অর্থ আত্মসাৎ এবং মেগা প্রকল্পে মেগা লুটপাট; প্রকল্পে সময় বৃদ্ধি—সবই চলছে পুরনো কায়দায়। এমনকি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একাধিক উপদেষ্টার কাছে ধর্ণা দিয়েও মেলেনি কোনো প্রতিকার, বরং ফাইল ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে খোদ মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে।

সিডিএকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই শক্তিশালী সিন্ডিকেট, হাজার কোটি টাকার লুটপাট এবং ভুক্তভোগী হুইসেল ব্লোয়ারদের জবানবন্দির ভিত্তিতে বাংলা এডিশনের বিশেষ অনুসন্ধান।

গত ১৫ বছরে সিডিএর দুর্নীতির মহোৎসব :

সিডিএর গত ১৫ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি মূলত দুজন ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে ছিল—আবদুস সালাম (১০ বছর) এবং জহিরুল আলম দোভাষ (৫ বছর)। তারা উভয়েই আওয়ামী লীগের উচ্চপদস্থ নেতা। অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রী-এমপি এবং দলীয় প্রভাবশালীদের তুষ্ট করতে তারা ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ২৫টি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেন, যার একটিও সঠিক সময়ে শেষ হয়নি।

প্লট দুর্নীতি :

২০১৩ সালে অনন্যা আবাসিক এলাকায় প্রকল্প অনুমোদন ও নকশা পরিবর্তনের মাধ্যমে প্লট বরাদ্দের দুর্নীতির একটি নজির সৃষ্টি হয়। ওই সময় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ৬০ জনকে সরাসরি প্লট বরাদ্দ দেয়, যার মধ্যে সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদসহ অনেক উচ্চ পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতার নামও রয়েছে।

প্লট দুর্নীতি মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে রায় ঘোষণা করা হলেও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে ওঠা সিডিএর প্লট দুর্নীতির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সিডিএর বর্তমান চেয়ারম্যানকে। তারা ঘটনাটিকে গুরুত্বহীন করে বা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে আসছেন, যাতে দায়ভার থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এবং সামনে আসতে না পারে।

মেগা প্রকল্প মানেই মেগা লুটপাট :

সিডিএর মেগা প্রকল্পগুলোতে ব্যয় বৃদ্ধি এবং সময়ক্ষেপণ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কয়েকটি প্রধান প্রকল্পের চিত্র নিম্নরূপ—

আউটার রিং রোড প্রকল্প :

২০১১ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ছিল ৮৫৬ কোটি টাকা। ৪ বার সংশোধনের পর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩,৩২৪ কোটি টাকায়। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এই প্রকল্পের অর্থ লোপাট করছেন সিডিএর কর্তারা। আউটার রিং রোড প্রকল্পে সিডিএর ৭ জন কর্মকর্তা নিযুক্ত ছিলেন। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী মূল বেতনের ১০ শতাংশ অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও সেখানে বেতনের আরও ৪০ শতাংশ অর্থ নিয়েছেন ওই কর্মকর্তারা।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠান তৎকালীন সামরিক উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিকীসহ ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের ‘আশীর্বাদপুষ্ট’ ছিল এবং অধিকাংশ কাজ পেয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে :

১৬ কিলোমিটারের এই উড়ালসড়ক নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে খরচ ২৭০ কোটি টাকা—যা নজিরবিহীন। শুরুতে ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা ধরা হলেও, পরবর্তীতে নকশা সংশোধনের নামে এক লাফে ১ হাজার ৪৮ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়। ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড এই কাজ করলেও পিলারে ফাটল দেখা দেওয়া এবং কাজের মান নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে।

জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প :

২০১৭ সালে ৫,৬১৬ কোটি টাকায় অনুমোদিত এই প্রকল্পটির ব্যয় ২০২২ সালে এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৯,৫২৬ কোটি টাকায়। মাত্র ১ সপ্তাহে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয় এই প্রকল্পের। ত্রুটিপূর্ণ কাজের কারণে জলাবদ্ধতা আরও বৃদ্ধি পেয়ে গত কয়েক বছরে অন্তত ১৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।

বিলাসী বিদেশ ভ্রমণ ও পরিবেশ ধ্বংস :

প্রকল্পের বরাদ্দের টাকায় আমলা ও বোর্ড সদস্যদের খুশি করতে ‘প্রমোদ ভ্রমণের’ আয়োজন করা হতো। ৬টি প্রকল্পের বিপরীতে ৩৪ জন কর্মকর্তা ১৪টি দেশ ভ্রমণ করেছেন, যাদের মধ্যে ২৩ জনই প্রকল্পের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না। একটি বাতিলকৃত প্রকল্পের (অনন্যা ২য় পর্যায়) নাম করে ১ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ভ্রমণ করেছেন সিডিএর কর্মকর্তারা।

পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব থাকলেও সিডিএ নিজেই পরিবেশ ধ্বংসে মেতেছিল। মাত্র ৬ কিলোমিটার রাস্তা ও বিভিন্ন আবাসন প্রকল্পের জন্য সিডিএ ১৮টি পাহাড় কেটেছে এবং জলাশয় ভরাট করেছে। প্রায় ৭০ হাজার ঘনফুট বেশি পাহাড় কাটা হয়েছে এবং খাড়া ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের সহায়তায় প্রায় ১ একর ২০ শতক পাহাড় কেটে ফয়’স লেক ভরাট করার অভিযোগও রয়েছে।

ডিটেল এরিয়া প্ল্যান অনুসারে চট্টগ্রাম সাজানোর দায়িত্বে থাকা উপপ্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (ভারপ্রাপ্ত) মো. আবু ঈসা আনসারীর নেতৃত্বে ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে পাহাড় ও পুকুর ভরাট করে ভবন নির্মাণের ঢালাও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

ভুয়া স্লিপে অর্থ আত্মসাৎ :

২০২৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর উদ্ঘাটিত হয় এক অভিনব জালিয়াতি। নকশা অনুমোদনের ফরম বিক্রির টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে ভুয়া ব্যাংক স্লিপের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন সিডিএ কর্মকর্তারা।

দুর্নীতিবাজদের ‘পুনর্বাসন কেন্দ্র’ :

সিডিএর গুরুত্বপূর্ণ পদে এখনও ২২টি দুর্নীতি মামলার আসামি বহাল তবিয়তে রয়েছেন। বিশেষ করে আউটার রিং রোডের পিডি কাজী হাসান বিন শামস একজন আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজ, যিনি ২০০৮ সালে ট্রুথ কমিশনে দায় স্বীকার করে সরকারি প্রকল্পের আত্মসাৎ করা টাকা ফেরত দিয়েছিলেন। সম্প্রতি কাজী হাসান বিন শামসকে শাস্তির বদলে পুরস্কার স্বরূপ রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে বদলি করা হয়েছে।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমানের ভূমিকা :

১৪টি প্রকল্পে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি তদন্তের জন্য গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কামাল উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের কমিটি ২০২৫ সালের ১১ জানুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু করে। তবে তদন্ত শেষ হওয়ার অল্প সময় আগে কমিটির প্রধানকে অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। রহস্যজনক এই পরিবর্তনের ফলে তদন্ত কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায় এবং পরবর্তীতে এর কোনো তথ্য বা ফলাফল প্রকাশ পায়নি।

চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধান খুঁজতে ১৯ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চারজন উপদেষ্টাকে বিশেষ দায়িত্ব দেন—সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, ফারুক-ই-আজম আদিলুর রহমান খান। কিন্তু সিডিএর জলাবদ্ধতা প্রকল্প কিংবা অতীত প্রকল্প-ক্ষতির দুর্নীতি নিয়ে তারা কোনো কঠোর অবস্থান নেননি।

এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মমন্ত্রণায়নের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের সাথে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি নিয়ে গত ১৫ বছরে শতাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রকল্পসংশ্লিষ্ট এমন কাউকেই আইনের আওতায় আনতে পারেনি। বরং যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাদের সম্মানজনক দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে—দেশে দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ হওয়া এই বিপুল অর্থের দায়ভার কে নেবে? এটি প্রমাণ করে সিডিএর সেই পুরনো সিন্ডিকেট এখনো অত্যন্ত শক্তিশালী এবং ধরাছোঁয়ার বাইরে।

অপরাধে সহায়তাকারীদের জন্য আইনের বিধান :

দুদক কর্মকর্তা বা উপদেষ্টা যদি দুর্নীতিবাজকে সহায়তা করে, সে ক্ষেত্রে নিচের ধারাগুলোতে তারা বড় অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হন। পরবর্তী যে কোনো সরকার প্রমাণসাপেক্ষে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে পারে।

দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ : স্বাধীন–নিরপেক্ষ দুদক প্রতিষ্ঠা; ১২ নং ধারায় দুর্নীতিতে সহায়তার সুনির্দিষ্ট অপরাধ সংজ্ঞায়িত হয়েছে।

দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ : সরকারি কর্মকর্তাদের অপরাধমূলক অসদাচরণে সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

পেনাল কোড, ১৮৬০ : কমপক্ষে ৩ বছর (সর্বোচ্চ ৭ বছর) কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড; মিথ্যা তথ্য প্রদান শাস্তিযোগ্য অপরাধ।



banner close
banner close