মঙ্গলবার

১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১ পৌষ, ১৪৩২

ঝড় বৃষ্টি ও শীতের সাথে লড়াই পলিথিন মোড়ানো ঘরে এক দম্পতির বেঁচে থাকার সংগ্রাম

বাগেরহাট প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১৬:১৯

শেয়ার

ঝড় বৃষ্টি ও শীতের সাথে লড়াই পলিথিন মোড়ানো ঘরে এক দম্পতির বেঁচে থাকার সংগ্রাম
ছবিঃ বাংলা এডিশন

বাগেরহাটের বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের কোড়ামারা গ্রামের এক কোণের ভাঙা ঝুপড়ি। ছেঁড়া পলিথিনে মোড়ানো তার ছাউনি। হোগলা আর নারকেল পাতার বেড়া প্রায় বিধ্বস্ত।

ঘরের অর্ধেক অংশই হেলে পড়েছে। একটু বাতাস হলেই পাখির বাসার মতো উড়ে যাবে এই ঝুপড়ি।

আর এই ঝুপড়ি ঘরেই দিন কাটে গোকুল সরদার আর তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মী রানী সরদার দম্পতির। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে একে অপরের সঙ্গ ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই তাদের। একমাত্র পলিথিনে মোড়ানো এই ঝুপড়ি ঘরটিই তাদের জীবনের শেষ আশ্রয়। এখানে প্রতিনিয়তই বৃষ্টি ঢোকে, বাতাস ঢোকে, শীতের কনকনে হাওয়া ঢোকে, কিন্তু আশার আলো কখনই ঢোকে না।

গোকুল সরদারের বয়স ৭৮ আর ৬০ বছরের লক্ষ্মীর জীবনে সুখের কোনো স্মৃতি নেই। তাদের জীবনে আছে শুধু সংগ্রাম, অনাহার, বঞ্চনা আর বেদনার গল্প। বয়সের ভারে হাঁটাচলা কঠিন হলেও খিদের যন্ত্রণা পিছু ছাড়ে না। তাই কখনো দিনমজুরি, কখনো প্রতিবেশীর বাড়িতে কাজ—যা পান, তাই দিয়ে দু’মুঠো ভাতের ব্যবস্থা করেন। তবে অনেক রাতই কেটে যায় ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই করে। তবুও তাঁরা কারও কাছে হাত পাতেননি। নিজের ঘাম, নিজের শ্রম বিক্রি করে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এখন বয়সের কাছে হেরে গেছেন। কাজের শক্তি নেই, পথচলার জোর নেই। আর সেই সঙ্গে প্রায় ভেঙে পড়ছে তাঁদের একমাত্র ঘরটিও। রাতভর বাতাসে দুলতে থাকে ছেঁড়া পলিথিন। বৃষ্টি আর শীতের রাতের শিশিরে বিছানা ভিজে যায়, পোশাক ভিজে যায়, শরীর ভিজে যায়। সকালের রোদ তাদের পোশাক শুকিয়ে দিলেও, তাদের অন্তরের ক্ষত কখনই শুকায় না।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে লক্ষ্মী রানী বলছিলেন, “আমাদের মতো এমন অসহায় আশপাশে কোথাও নাই। বর্ষাকালে সারারাত ঘুমাতে পারিনি। আমাদের সবকিছু ভিজে গেছে। পলিথিন মুড়ি দিয়ে খেয়ে-না-খেয়ে রাত কাটিয়েছি। চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কাছে অনেকবার গিয়েছি। আমরা আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পাইনি। এই শীতের সময় ভাঙা বেড়া দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢোকে, উপর থেকে শিশির পড়ে আমাদের বিছানা ভিজে যায়। আমরা নিজেরাই ঠিকমতো খাবার খেতে পারি না, ঘর মেরামত করবো কি দিয়ে? আমার স্বামী দিনমজুরি করে যা পায়, তাই দিয়ে খেয়ে-না-খেয়ে বেঁচে আছি। জীবনের শেষ বয়সে এসে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই ছাড়া কিছুই চাওয়ার নেই।”

গোকুল সরদার বলেন, “আমরা খুবই অসহায় মানুষ। তারপরও কারোর কাছ থেকে হাত পেতে কিছুই নেইনি। এখনো পর্যন্ত দিনমজুরি করে যা পাই তাই দিয়ে দুবেলা খাই, না পেলে না খেয়ে থাকি। বিগত সরকারের সময় ঘর দিছে শুনে একটি ঘর পাওয়ার জন্য চেয়ারম্যান, মেম্বার, টিএনও অফিসে অনেকবার ঘুরেছি। সবাই আশ্বাস দিলেও বাস্তবে কিছুই পাইনি।”

এই দম্পতির মানবেতর জীবনযাপন চোখের সামনে থাকলেও সরকারি সহায়তা না মেলায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ক্ষোভ।

স্থানীয় বাসিন্দা সাগর দাস, জালাল শেখ, সেকেন্দারসহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, এই ঝুপড়ি ঘরে এই দুই দম্পতি মানবেতর জীবনযাপন করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় চেয়ারম্যান-মেম্বার বহুবার আসা-যাওয়া করলেও এই অসহায় দম্পতিকে কেউ দেখেনি। অনেকের অনেক কিছু থাকার পরেও তারা ঘর পেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তারা ঘর পাওয়ার যোগ্য হলেও তাদেরকে ঘর দেওয়া হয়নি। এই ঝুপড়ি ঘরটি যেকোনো সময় ভেঙে পড়ে তারা চাপা পড়তে পারেন।

সরকার এবং বিত্তশালীদের কাছে তাদের একটি ঘর তৈরি করে দেওয়ার জন্য আবেদন জানান তারা।

বাগেরহাট জেলা প্রশাসক গোলাম মোঃ বাতেন বলেন, “বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। প্রতি বুধবার আমাদের গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। গণশুনানিতে তারা বিষয়টি উত্থাপন করলে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”



আরও পড়ুন:

banner close
banner close