চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (ভারপ্রাপ্ত) জনাব মোঃ আবু ঈসা আনসারীর বিরুদ্ধে নিয়োগ জালিয়াতি, ঘুষ বাণিজ্য, পুকুর ভরাট, পাহাড় নিধন এবং মাস্টারপ্ল্যানের গোপন তথ্য বিক্রিসহ ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত নথিপত্র ও অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য উঠে এসেছে।
নিয়োগ জালিয়াতির মাধ্যমে উত্থান
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ২০০৮ সালের ২৭ জুলাই তারিখে "দ্য ডেইলি ইন্ডিপেন্ডেন্ট" সহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এই বিজ্ঞপ্তিতে "টাউন প্ল্যানার" (গ্রেড-৬) এবং "সিস্টেম অ্যানালিস্ট" সহ কয়েকটি শূন্য পদের জন্য যোগ্য প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদন আহ্বান করা হয়েছিল।
নিয়োগের নির্ধারিত শর্তাবলী
"টাউন প্ল্যানার" পদের জন্য সিডিএ কর্তৃক সুনির্দিষ্ট যোগ্যতার মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছিল:
১. শিক্ষাগত যোগ্যতা: প্রার্থীকে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে স্নাতক ডিগ্রিধারী হতে হবে।
২. অভিজ্ঞতা: সরকারি/আধা-সরকারি/স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা পদে ন্যূনতম ৬ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকা বাধ্যতামূলক।
৩. বয়সসীমা: প্রার্থীর বয়স কমপক্ষে ৩৫ বছর হতে হবে।
এছাড়াও, নিয়োগ পত্রে চ নং শর্তে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়, আবেদনকারী সত্য গোপন করে প্রতারণামূলকভাবে কোন তথ্য/সনদ ইত্যাদি প্রদান করলে এ নিয়োগ বাতিল বলে গণ্য হবে ও পরবর্তী পর্যায়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবুও তিনি বহাল তবিয়তে চাকুরি করে যাচ্ছেন।
ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র বা (LUC) বাণিজ্যের ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেট জালিয়াতি
আবু ঈসা আনসারী চউকের ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র (LUC) শাখাকে ঘুষ বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। উল্লেখযোগ্য কিছু দুর্নীতির চিত্র নিচে তুলে ধরা হলো:
অভিযোগ রয়েছে চট্টগ্রামের বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের কাছ থেকে কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে নগরের চেরাগী পাহাড় মোড়ে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ও ‘ওপেন টু স্কাই’ শর্ত অমান্য করে ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র দিয়ে ২২ তলা বিশিষ্ট বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের সুযোগ করে দেন। এছাড়াও আগ্রাবাদে মুনতাসির বিল্ডিং লিমিটেডকে সরকারি রাস্তা কে ব্যক্তিগত রাস্তা হিসেবে চিহ্নিত করে কোটি টাকার বিনিময়ে অবৈধ বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ ছাড়পত্র প্রদান করেন।
অন্যদিকে, জামাল খান, হেমসেন লেইন কোতোয়ালীতে গোপী নাথ ধরের রাস্তার প্রশস্ততা জালিয়াতি করে বাড়িয়ে দেখিয়ে প্রথমে ছাড়পত্র প্রদান করেন, পরে অভিযোগ উঠলে কারণ দর্শানো ছাড়াই তা ছাড়পত্র বাতিল করেন।
পুকুর ভরাট ও জলাধার ধ্বংস: পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে একের পর এক পুকুর ভরাটের অনুমোদন দিয়েছেন তিনি। বাকলিয়ায় ফরিদুল ইসলাম গং-এর একটি পুকুর ভরাট প্রথমে প্রত্যাখ্যান করলেও পরবর্তীতে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সেটিকে আবাসিক প্লট হিসেবে অনুমোদন দেন। একইভাবে,নগরীর শুলকবহর মৌজার ২০০ বছরের প্রাচীন ‘বালতি কোম্পানির পুকুর’ এবং পশ্চিম ষোলশহরের ফরিদা বেগমের পুকুর ভরাটের জন্যও তিনি অনৈতিকভাবে ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র প্রদান করেন, যা নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা ও ছাড়পত্র বাতিলের সুপারিশ করেছে।
পাহাড় ও সংরক্ষিত এলাকা দখল: জামালখানের আসকার দিঘীর পাড়ে সংরক্ষিত পাহাড়ের ঢালের রেকর্ড পরিবর্তন করে এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই তিনি ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র প্রদান করেন। এছাড়া পাঁচলাইশে ড্যাপ চিহ্নিত ‘কমিউনিটি ফ্যাসিলিটিজ’ জোনে নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন ছাড়াই বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন।
সন্দ্বীপের মো: দিদারুল আলমের জমিতে কোনো পুকুর না থাকলেও ঘুষ না দেওয়ায় তার জমিকে ‘রিটেনশন পন্ড’ দেখিয়ে ছাড়পত্র আটকে দেন।
মাস্টারপ্ল্যান ও ব্যাংক স্লিপ মাধ্যমে জালিয়াতি
প্রায় ৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন মাস্টারপ্ল্যান প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে তিনি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিক্রি করে দিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে ভবিষ্যৎ সরকারি অ্যালাইনমেন্ট, খাল, ও জোনিং সংক্রান্ত তথ্য পাচার করেছেন। এছাড়া, চউকের নকশা অনুমোদনের ব্যাংক স্লিপ জালিয়াতি করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎকারী চক্রের সাথে তার ব্যক্তিগত সহকারী মোঃ সোহেলে সরাসরি সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে এই বিষয়ে তিনি চউকের গঠিত তদন্ত কমিটিকে তথ্য দিতে অসহযোগিতা করেন।
আল জাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খানের তথ্যানুসারে, আবু ঈসা আনসারী প্রায় ১৬০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
দেশে সম্পদ: বাবার নামে চট্টগ্রামের চন্দনপুরাস্থ চন্দন হাইটসে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট এবং ভবিষ্যতে বাকলিয়ায় সরকারি অধিগ্রহণ হতে পারে এমন এলাকায় ১০ কাঠার প্লট কিনেছেন।
চট্টগ্রামের একজন সেবা প্রার্থী এবং ভুক্তভোগী গত ১৪ মাস ধরে গৃহায়ন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবর এই সকল দুর্নীতি বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ও প্রমাণ সহ একাধিকবার লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। তবে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বর্তমান চেয়ারম্যান কেউই এই বিষয়ে কোন প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
এই অবহেলা থেকে স্পষ্ট হয় যে, জনাব আবু ঈসা আনসারী নামে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির সঙ্গে সর্বোচ্চ মহল পর্যন্ত ইন্ধন রয়েছে, যার ফলে কার্যকর তদন্ত ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থা গ্রহণে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে আবু ঈসা আনসারীর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিকের পরিচয় পেয়ে ফোন কেটে দেন।
আবু ঈসা আনসারীর বিরুদ্ধে অবৈধ ল্যান্ড সার্টিফিকেট তৈরি ও ডেভেলপারদের অবৈধ সুযোগ দিয়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগের তদন্ত পরিসমাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০১৭ সাল থেকে এই অভিযোগের তদন্ত করছিল।
অভিযোগ মতে, ২০২৩ সাল থেকে দুদক সমন্বিত চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়–১ উপ-পরিচালক নাজমুস সাদাত ও তদন্তকারী কর্মকর্তা রাজু আহমেদের হাতে আবু ঈসা আনসারীর বিরুদ্ধে অবৈধ ল্যান্ড সার্টিফিকেট প্রমাণ থাকার পরেও চলতি বছরের ২৭শে মার্চ, ২০২৫ তারিখে দুদক আনসারীর বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ পরিসমাপ্তি ঘোষণা করে। এই পরিসমাপ্তি জনমনে গভীর সন্দেহের সৃষ্টি করেছে।
এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়–১ উপ-পরিচালক কাছে অভিযোগ-সংক্রান্ত তথ্য ও প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে উল্টো এই অভিযোগের তদন্ত পরিসমাপ্তি করা হলো?
এ বিষয়ে দুদকের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়–১ উপ-পরিচালক নাজমুস সাদাত ও তদন্তকারী কর্মকর্তা রাজু আহমেদের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে ফোন রিসিভ করেননি।
আইনগত পর্যায়
বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ ও দণ্ডবিধি ১৮৬০ অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারী হিসেবে বিশ্বাসভঙ্গ, জালিয়াতি এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। চাকরি গ্রহণের সময় জালিয়াতি প্রমাণিত হলে দণ্ডবিধির ৪৬৮ ও ৪৭১ ধারায় ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
দণ্ডবিধি, ১৮৬০: জালিয়াতি, প্রতারণা, এবং মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানের জন্য (ধারা ৪২০, ৪৬৫, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১) শাস্তির বিধান রয়েছে। এই ধারায় সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হতে পারে।
জালিয়াতির মাধ্যমে অর্জিত বেতন-ভাতা রাষ্ট্রের কোষাগারে ফেরত দেওয়ার নির্দেশও আদালত দিতে পারেন।
আরও পড়ুন:








