বৃহস্পতিবার

৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ২০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

আখ মাড়াই মওসুম শুরু হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী কেরু অ্যান্ড কোম্পানীর চিনিকলে

রেজাউল করিম লিটন, চুয়াডাঙ্গা

প্রকাশিত: ৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১৯:৪৪

শেয়ার

আখ মাড়াই মওসুম শুরু হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী কেরু অ্যান্ড কোম্পানীর চিনিকলে
ছবি: বাংলা এডিশন

২০২৫-২৬ আখ মাড়াই মওসুম শুরু হচ্ছে দেশের ঐতিহ্যবাহী চিনিকল চুয়াডাঙ্গার দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানীতে। শুক্রবার (০৫ ডিসেম্বর) বিকেলে চিনিকলের কেইন ক্যারিয়ারে আখ নিক্ষেপের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এবারের মাড়াই মওসুম উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশ সরকারের শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। কেরু চিনিকল কর্তৃপক্ষ এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের সবচেয়ে বড় চিনিকল দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানি। চিনি উৎপাদন কারখানা, ডিস্টিলারি, জৈব সার কারখানা, বাণিজ্যিক ও পরীক্ষামূলক খামার এবং ওষুধ কারখানার সমন্বয়ে গঠিত এ বৃহৎ শিল্প কমপ্লেক্সের চিনি কারখানাটি দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহতভাবে লোকসান গুনে আসছে। সরকারিভাবে চিনির মূল্য বৃদ্ধির কারণে কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে চিনিকলটি।

প্রায় ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে মিল হাউসে নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজন করে চিনিকলটি আধুনিকায়নের কাজ চলছে। এতে আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়বে। তবে এলাকায় আখ চাষ ক্রমাগত কমতে থাকায় সংকটে পড়েছে দেশের ঐতিহ্যবাহী এই চিনিকলটি।

চলতি মওসুমে ৭৬ হাজার টন আখ মাড়াই করে ৪ হাজার ২৫৬ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চিনি আহরণের হার ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৬০ শতাংশ। প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ১৫০ টন আখ মাড়াই করবে চিনিকলটি। ৭০ থেকে ৭৫ দিন চালু থাকবে। দণ্ডায়মান আখ রয়েছে ৫ হাজার ৫৬২ একর জমিতে। এর মধ্যে চিনিকলের নিজস্ব খামারে ১ হাজার ৬২৫ একর এবং চাষির ৩ হাজার ৯৩৭ একর জমিতে।

২০২৪-২৫ মাড়াই মওসুমে প্রায় ৭০ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৪ হাজার ৪৫২ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ৬৫ দিন উৎপাদনে থেকে শতকরা ৬ ভাগ চিনি আহরণের মাধ্যমে প্রায় ৪ হাজার টন চিনি উৎপাদনে সক্ষম হয়।

২০২৩-২৪ মওসুমে ৬৫ হাজার টন আখ মাড়াই করে ৪ হাজার টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। মোট ৫৫ মাড়াই দিবসের লক্ষ্যে চিনি আহরণের গড় হার ধরা হয়েছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ। এর বিপরীতে চিনিকলটি ৫৬ হাজার ৪১৪ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ২ হাজার ৬০৮ টন চিনি উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। চিনি আহরণের হার ছিল ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। আখের অভাবে নির্ধারিত সময়ের আগেই মাড়াই মওসুম বন্ধ হয়ে যায়।

চিনিকলের শ্রমিকরা জানান, এ বছর মিল হাউসের ফিটিংয়ের কাজ ভালো হয়েছে। মিল ভালোই চলবে। ফলে বেশি চিনি উৎপাদন সম্ভব হবে।

কেরু অ্যান্ড কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাব্বিক হাসান বলেন, ‘মাড়াই মওসুম শুরু করতে চিনিকলের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। এ মওসুমে চিনি কারখানায় লোকসান কমিয়ে আনতে সবাই মিলে কাজ করছে। এ ছাড়াও এ মওসুমে কোদাল দিয়ে আখ কাটার পদ্ধতি চালু করা হবে। এতে কয়েক হাজার টন আখ বেশি পাওয়া যাবে। চিনির উৎপাদনের পরিমাণও বাড়বে।’

চাষিদের দাবির প্রেক্ষিতে এ মওসুমে আখের মূল্য বাড়িয়েছে সরকার। এবার প্রতিমণ (৪০ কেজি) আখের মূল্য ২৫০ টাকা করা হয়েছে। তবে চিনির মূল্য বাড়লেও আশানুরূপ হারে আখের মূল্য বাড়েনি। আখের মূল্য আরও বাড়ানোর দাবি চাষিদের।

কেরু চিনিকল আখচাষী কল্যাণ সংস্থার সেক্রেটারি হাজী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘চিনিকল কর্তৃপক্ষের কাছে আখচাষীদের এবারের দাবি—চাষিদের মাঝে আখ বিক্রির পুঁজির পরিমাণ বাড়াতে হবে। ঋণের সার, বীজ, কীটনাশক সঠিক সময়ে দিতে হবে এবং চাষিদের কোটায় পাওনা চিনি উত্তোলনের সময় বাড়াতে হবে। আখের দাম ন্যূনতম প্রতিমণ ৩০০ টাকা করতে হবে। চাষিদের কাছ থেকে কেটে নেওয়া টাকা সম্পূর্ণটাই আখচাষী কল্যাণ সংস্থায় জমা করতে হবে।’

১৮০৫ সালে মি. জন ম্যাকসওয়েল নামক এক ইংরেজ তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ভারতের কানপুরের জাগমু নামক স্থানে তৎকালীন একমাত্র ফরেন লিকার কারখানাটি চালু করেছিলেন। অতঃপর বিভিন্ন সময়ে এর নাম, স্থান, মালিকানা, উৎপাদন ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হতে থাকে। ১৮৪৭ সালে মি. রবার্ট রাসেল কেরু অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এ প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হন এবং কালক্রমে তা ক্রয় করে নেন। উত্তর ভারতের রোজায় অবস্থানকালীন ১৮৫৭ সনের সিপাহী বিপ্লবের সময় কারখানাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে তা পুনর্নির্মাণপূর্বক জয়েন্ট স্টক কোম্পানি গঠন করে ‘কেরু অ্যান্ড কোম্পানি লি.’ হিসেবে নতুন নামকরণ করা হয়। রোজায় ব্যবসা উন্নতি লাভ করলে আসানসোল ও কাটনীতে এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৮ সনে প্রাথমিকভাবে দৈনিক ১ হাজার টন আখ মাড়াই ও ১৮ হাজার প্রুফ লিটার স্পিরিট তৈরির লক্ষ্যে আরও একটি শাখা তদানীন্তন নদীয়া জেলার অন্তর্গত দর্শনায় স্থাপন করা হয়।

১৯৬৮ সনে ইংরেজরা এ দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (পাকিস্তান) লি.-এর স্থলে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ইপিআইডিসির ওপর ন্যস্ত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠানটি জাতীয়করণ করা হয়। তখন থেকে অদ্যাবধি এটি কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লি. নামে শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব খাতে সর্বোচ্চ ১৫০ কোটি টাকা জমা দিয়েছে। এ বছর মুনাফার পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১৩০ কোটি। কেরু অ্যান্ড কোম্পানীর ৬টি ইউনিটের মধ্যে ৫টি—ডিস্টিলারি, জৈব সার কারখানা, বাণিজ্যিক খামার, পরীক্ষামূলক খামার ও ফার্মাসিউটিক্যাল—আয়কর বাদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১১২ কোটি ৭ লাখ টাকা মুনাফা করেছে। কেবলমাত্র চিনিকল ৬১ কোটি ৭ লাখ টাকা লোকসানে রয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক চললে চিনিতে মোটা অঙ্কের লোকসান কমিয়ে আনতে পারবে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি—এমনটিই আশা করছে কর্তৃপক্ষ।



banner close
banner close