বৃহস্পতিবার

৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ২০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

সুনামগঞ্জে নদীর পাড় কেটে বালু উত্তোলন, বিলীন হওয়ার পথে কয়েকটি গ্রাম

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১৪:০৭

আপডেট: ৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১৪:৩২

শেয়ার

সুনামগঞ্জে নদীর পাড় কেটে বালু উত্তোলন, বিলীন হওয়ার পথে কয়েকটি গ্রাম
ছবি: বাংলা এডিশন

কপালে ভাঁজ, মুখে মলিনতা—গালে হাত দিয়ে বসে আছেন বৃদ্ধ রফিজ মিয়া। ষাটোর্ধ্ব বয়সে এসে বাবার রেখে যাওয়া বসতঘর ছাড়ার কষ্টের কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে নিজের চোখের সামনেই বসতঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে; কিন্তু কিছুই করার নেই, কারণ এই লুটপাটের পেছনে রয়েছে একাধিক প্রভাবশালী সিন্ডিকেট।

সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার নরসিংপুর ইউনিয়নের চেলা নদীর পাড় কেটে চলছে বালু লুটপাটের মহোৎসব। একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট দিন-রাত সমানতালে নদীর তীর কেটে বালু উত্তোলন করছে। ভাঙনের কবলে পড়েছে নরসিংপুর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম; নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে শতাধিক বসতঘর। স্থানীয়দের অভিযোগ, নিজেদের দায় এড়াতে উপজেলা প্রশাসন মাঝে মাঝে নামমাত্র অভিযান চালায়—শতাধিক বালুভর্তি নৌকার মধ্যে দু-একটি নৌকা আটক করাকেই তারা অভিযান বলে দাবি করে।

সনাতন পদ্ধতিতে বালু তোলার জন্য কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব দিয়ে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে চেলা নদীর ইজারা হয়। কিন্তু প্রশাসনের যোগসাজশে ইজারাদার ও স্থানীয় প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে নদীর পাড় কেটে বালু উত্তোলন করছে। ইজারার নিয়ম অনুযায়ী নদীর তীর থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বালু তোলার কথা থাকলেও তারা কিছুই মানছে না। বিকেল ৪টা পর্যন্ত বালু তুলতে নির্ধারিত সময়সীমা থাকলেও রাতের বেলায়ই বেশি বালু লুট হচ্ছে—এমনি কিছু ভিডিওচিত্র প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।

পাড় কেটে বালু উত্তোলনের ফলে ইতোমধ্যে চেলা নদীর তীরবর্তী ছয়টি গ্রাম—সারপিনপাড়া, পূর্বচাইরগাঁও, সোনাপুর, রহিমেরপাড়া, পূর্বসোনাপুর ও নাছিমপুর—এর বহু পতিত জমি, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

বাংলা এডিশনের প্রতিবেদকের কাছে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, নদীর পাড় কেটে বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত ইজারাদার, রাজনৈতিক দলের নেতা এবং প্রশাসনের একটি অংশ। গত কয়েক বছর ধরে ইজারার নামে একসময়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত চেলা নদীর তীরে চলছে পরিবেশ ধ্বংসের বেপরোয়া তাণ্ডব। এভাবে চলতে থাকলে নদীটি রূপ নেবে সাগরে, আর ভাঙন অব্যাহত থাকায় পুরো এলাকার মানুষ দিন কাটাচ্ছে আতঙ্কে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, স্থানীয় কিছু অসাধু ব্যক্তির হাতেই রমরমা চলছে চেলা নদীর পাড় কেটে বালু উত্তোলনের এ মহোৎসব। বিজিবি, স্থানীয় প্রশাসন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদেরও সম্পৃক্ততার অভিযোগ করেন তিনি।

নদীর তীর কাটার কারণে নদীর গতিপথ ইতোমধ্যে অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ না হলে এর ভয়াবহতা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।

দোয়ারাবাজার উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ও সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সামছুল হক নমু বলেন, “প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর চেলা নদী একসময় এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র ছিল। সনাতন পদ্ধতিতে বেলচা দিয়ে বালু তুললে বহু বছর কাজ করা যেত। কিন্তু সব নিয়ম উপেক্ষা করে এলাকার লেবাসধারী একটি চক্র নদী লুটপাট করছে।”

একসময় পর্যটন স্পট হিসেবে পরিচিত ছিল চেলা নদী। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পর্যটকরা এখানে ঘুরতে আসতেন। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ইজারার দোহাই দিয়ে চলছে বালু লুটের এই কান্ড।

এ বিষয়ে দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অরুপ রতন সিংহ বলেন,

“সীমান্ত অতিক্রমকারী কয়েকটি নৌকা ইতোপূর্বে জব্দ করা হয়েছে। বিজিবিকে টহল জোরদারের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।”



banner close
banner close