রবিবার

১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৩০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

অক্সিজেন–কুয়াইশ সড়ক দুর্নীতি মামলা; প্রকল্প পরিচালককে চার্জশিট থেকে সুকৌশলে বাদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১৩:৫৯

শেয়ার

অক্সিজেন–কুয়াইশ সড়ক দুর্নীতি মামলা; প্রকল্প পরিচালককে চার্জশিট থেকে সুকৌশলে বাদ
কাজী হাসান বিন শামস। ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত অক্সিজেন–কুয়াইশ সড়ক নির্মাণ দুর্নীতি মামলা থেকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রকল্প পরিচালক ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসকে চূড়ান্ত চার্জশিট থেকে ‘সুকৌশলে বাদ’ দেয়া হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক ও চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন পাশাপাশি পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে—অভিযোগের ভিত্তি, প্রমাণের উৎস, পরিমাপ পদ্ধতি ও আইনি বিশ্লেষনে ধাপে ধাপে এমন পরিবর্তন আনা হয়েছে যাতে একটি ‘স্পষ্ট অর্থ আত্মসাৎ’ মামলাকে শেষ পর্যন্ত “তথ্যগত ভুলজনিত মামলা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

২০০৬ সালের ২১ জুন থেকে ২০০৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাস্তবায়িত অক্সিজেন জংশন থেকে কাপ্তাই রোড পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের লট নং–১৭ ও ২৫–এ দুটি ক্রস কালভার্ট বাস্তবে নির্মাণ না করেই বিল প্রস্তুত করে সিডিএ কার্যালয়ে জমা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এভাবে কালভার্ট দুটির বিপরীতে যথাক্রমে ৫৯১,৩৩২ ও ৫৯০,৫০১ টাকা উত্তোলন করে মোট ৭৬৭,৫৮১ টাকা অতিরিক্ত অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে—এমনটাই অভিযোগে উল্লেখ ছিল।

প্রাথমিক তদন্তে সওজের কঠোর পরিমাপ ও আর্থিক গরমিল

২০০৮ সালে সড়ক ও জনপথ (সওজ)–এর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী রানা প্রিয় বড়ুয়া ও উপসহকারী প্রকৌশলী আব্দুল মতিন সরেজমিনে পুনঃপরিমাপ করে দেখেন— প্রকৃত কাজ হয়েছে ৪,১৪,২৫২ টাকার। কিন্তু বিল উত্তোলন করা হয়েছে ১১,৮১,৮৩৩ টাকার। এই বিশাল পার্থক্য এবং এমবি–বিল জালিয়াতির অভিযোগের ভিত্তিতেই দুদক তখন নিয়মিত মামলা রজু করে।

কিন্ত ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর আসামি কাজী হাসান বিন শামস দুদক বরাবর আবেদন করে অভিযোগ তোলেন, ২০০৮ সালের পরিমাপে প্রকৌশল গাইডলাইন মানা হয়নি। এরপর দুদক চেয়ারম্যান একটি চিঠিতে তদন্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন, যদি পূর্বের বিশেষজ্ঞ পরিমাপে গাইডলাইন না মানা হয়ে থাকে এবং এতে ন্যায়বিচার ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে নতুন করে পুনঃপরিমাপ করা যেতে পারে।

অভিযোগ ওঠে, এই নির্দেশের মাধ্যমে সওজের রিপোর্টকে ‘চ্যালেঞ্জ’ করার আনুষ্ঠানিক পথ খুলে দেওয়া হয়।

পরে এলজিইডি ও ডিপিএইচ ই –এর চারজন প্রকৌশলীকে ‘নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ১৭টি লটের মধ্যে কয়েকটি কালভার্ট পুনঃপরিমাপ করানো হয়। তাঁরা সওজ রিপোর্ট সম্পর্কে বলেন— হ্যান্ড স্কেচে লোড ক্যালকুলেশন, সয়েল বেয়ারিং, ডিজাইন অ্যানালাইসিস মানা হয়নি।

চেইনেজ/লোকেশন স্পষ্ট নয়, পানির কারণে নিচের অংশ সঠিকভাবে মাপা যায়নি।

ফলে প্রথম তদন্তের মূল ভিত্তি সওজ রিপোর্টকে টেকনিক্যালি দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়—যা আসামিদের জন্য বড় আইনি সুবিধা হয়ে দাঁড়ায়।

এলজিইডি ও ডিপিএইচ ই–এর পুনঃপরিমাপে দেখা যায়— লট ১৭–এ ব্যয়: ৫,৯০,৬৮০.৪৯ টাকা; বিল: ৫,৯১,১৭৮.১৯ টাকা; পার্থক্য মাত্র ৪৯৭.৭০ টাকা। লট ২৫–এ ব্যয়: ৫,৯০,০০৩.৪৩ টাকা; বিল: ৫,৯০,৫০১.১৩ টাকা; পার্থক্য ৪৯৭.৭০ টাকা

মোট পার্থক্য দাঁড়ায় মাত্র ১,১৪৯ টাকা, যা তদন্তকারীরা ‘১৮ বছরের Depreciation–জনিত স্বাভাবিক ক্ষয়’ বলে মন্তব্য করেন।

এ পর্যায়ে এমবি ও বিলে প্রকৌশলীদের স্বাক্ষর ও ‘Check and found correct’ মন্তব্যগুলোকে অপরাধমূলক নয়, বরং স্বাভাবিক অফিসিয়াল সার্টিফিকেশন হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়।

সাবেক তদন্ত কর্মকর্তার রিপোর্ট উপেক্ষিত

সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির ২০১২ সালে যে রিপোর্ট জমা দিয়েছিলেন—যেটি আসামি–বিরোধী ছিল বলে অভিযোগ—তা চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখই করা হয়নি। ফলে পুরোনো findings আড়াল রেখে শুধু নতুন আইও–র মতামত উপস্থাপন করা হয়েছে—যা আসামি–সুবিধাজনক বলে সমালোচনায় রয়েছে।

অক্সিজেন–কুয়াইশ সড়কের ৫.৫ কিলোমিটার পুনর্নির্মাণ (২০১৩–২০১৫) পুরোনো কালভার্টের অবস্থায় বড় প্রভাব ফেলতে পারতো। এছাড়া ২০০৭ সালে সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী এজিএম সেলিম ও সহকারী প্রকৌশলী রাজীব দাস প্রকল্প এলাকায় অনিয়মের যে রিপোর্ট দেন—যা ২০০৮ সালের মামলার অন্যতম উৎস—সেটিও চূড়ান্ত প্রতিবেদনে গুরুত্ব পায়নি।

ট্রুথ কমিশনে দায় স্বীকারের ঘটনাও বাদ

অভিযোগ রয়েছে, ২০০৮ সালে কাজী হাসান বিন শামস ট্রুথ কমিশনে গিয়ে দুর্নীতির দায় স্বীকার করে ৩ লাখ টাকা জমা দেন। পরে আদালত ট্রুথ কমিশন অবৈধ ঘোষণা করায় মামলা ফের সচল হয়। এ ধরনের দায় স্বীকার দুর্নীতি মামলায় গুরুত্বপূর্ণ হলেও চূড়ান্ত রিপোর্টে এটি উল্লেখ করা হয়নি।

চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এজাহারে বর্ণিত কাজ কম করে মিথ্যা পরিমাপ দেখিয়ে ৭,৬৭,৫৮১ টাকা আত্মসাৎ–এর কোনো প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়নি,

এফআর ও এমএফ দাখিলের সুপারিশ করা হয়েছে এবং দুদক সদর দপ্তর আইন অনুযায়ী এটি অনুমোদন করেছে। আদালত যদি এই এফআর গ্রহণ করেন, তাহলে মামলা এখানেই চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়ে যাবে; আসামিদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না।

এ বিষয়ে কথা বলতে কাজী হাসান বিন শামসকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি।

চূড়ান্ত তদন্তে সেগুলোর বড় অংশই এড়িয়ে যাওয়া বা ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর ফলে একটি সম্ভাব্য অর্থ আত্মসাৎ মামলাকে ধাপে ধাপে এমনভাবে দুর্বল করা হয়েছে, যাতে সেটি শেষ পর্যন্ত তথ্যগত ভুল হিসেবে আসামিদের শাস্তিমুক্তির পথ করে দেয়।

মামলার সর্বশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা সহকারী পরিচালক মোঃ এমরান হোসেনর মোবাইলে মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোন উত্তর না দিয়ে ফোন রেখে দেন।



banner close
banner close