রবিবার

১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৩০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

কাজ পেতে কর্মকর্তাদের দিতে হয় কমিশন; উন্নয়নের নামে বাস্তবে ফাঁকা বুলি

রাকিব হাসান, মাদারীপুর

প্রকাশিত: ২৫ নভেম্বর, ২০২৫ ১৩:১৭

আপডেট: ২৫ নভেম্বর, ২০২৫ ১৩:৩৭

শেয়ার

কাজ পেতে কর্মকর্তাদের দিতে হয় কমিশন; উন্নয়নের নামে বাস্তবে ফাঁকা বুলি
ছবি: সংগৃহীত

মাদারীপুর সদর উপজেলার ১৫ ইউনিয়নে ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার কর্মসূচি (কাবিটা, কাবিখা) ও দাখিলকৃত ভূমি হস্তান্তর করের ১% অর্থ বরাদ্দে বিগত বছরগুলোর মতো বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এ সব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে রাস্তা পূণনির্মাণ, ছোট ছোট বক্স কালভার্ট, মসজিদ-মন্দির সংস্কার, কবরস্থানের মাটি ভরাট। এইসব প্রকল্পের এমন কোন জায়গা নেই যেখানে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়নি। সুবিধা বঞ্চিতরা সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের সাথে যুক্ত দুর্নীতিবাজদের হুমকি ও চাপে কথা বলারও সাহস পায়নি। এমনকি তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিকরাও হয়েছেন হেনস্তার শিকার। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যোগসাজসে প্রভাবশালীরা এসব প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা কাজ না করেই হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরে ভূমি হস্তান্তর করের ১%এ অর্থ দ্বারা ১৫ ইউনিয়নের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে বরাদ্দ ছিলো ৩ কেটি টাকা। একই অর্থ বছরে কাবিখা (চাল) প্রথম, দ্বিতীয় ও ৩য় পর্যায়ে বরাদ্দ দেয়া হয় ১৬৬.২৬৩ মেট্রিক টন গম এবং ১৬৬.২৬৩ মেট্রিক টন চাল। এই সব মালের মধ্যে চালের সরকারী মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিলো ৯৩ লাখ ৭৪ হাজার ২৩২টাকা এবং গমের মূল্য ৭৬ লাখ ৪১ হাজার ৩৩৬ টাকা। একই সাথে নগদ বরাদ্দ ১কোটি ৬৬লাখ, ৯৬হাজার ৯১২টাকা। এতে দেখা যায় ১%, কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পে সর্বমোট ৭ কোটি ২০লাখ ৭০ হাজার ৯৩৬.৪৫ টাকা। অফিস কর্তৃক প্রদত্ত নথীপত্র মোতাবেক অনুসন্ধান করে এসব পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, এই বিপুল পরিমান টাকার তিন ভাগের একভাগ কাজও বাস্তবায়ন হয়নি প্রকল্প এলাকায়। তাহলে এই বিপুল অংকের টাকা গেলো কোথায়? এসব জানতে চায় ১৫ ইউনিয়নের সর্বস্তরের মানুষ।

সূত্রমতে জানা যায়, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে প্রকল্প প্রস্তাবনা আকারে উপজেলায জমা দেওয়া হয় এবং প্রকল্প পাওয়ার পরে এর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দিতে হয় অতিরিক্ত অর্থ। এরপর প্রকল্প পাওয়ার পরে তা বাস্তবায়নে নামে করা হয় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি। এ সবের প্রমাণ মিলেছে সরেজমিনে অনুসন্ধানকালে বিভিন্ন এলাকার উন্নয়ন বঞ্চিত সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে।

একদিকে সরকারের কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি, অন্যদিকে প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, সচিব ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিগত দিনের মতো নিজেরা দিন দিন আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাচ্ছে। এ বিষয়টি নিয়ে প্রকল্প এলাকার মানুষের মনে নানা প্রশ্ন ওঠার পাশাপশি নেতিবাচক আলোচনা সমালোচনার ঝর বয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ জনগনের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টিও হয়েছে। ফলে সুবিধা বঞ্চিতরা তাদের এলাকার উন্নয়ন থেকে আরো বঞ্চিত হচ্ছে। এসব প্রকল্পে চলমান দুর্নীতি ও অনিয়ম যেনো নিয়মে পরিণত হয়েছে। আবার কোন কোন ওয়ার্ডের মেম্বাররাও জানে না যে, প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে অফিস থেকে দেওয়া নথীপত্র যাচাই বাছাই করে দেখা গেছে বিল উত্তোলন করে নিয়ে গেছে অনেক আগেই।

স্থানীয়রা অভিযোগ করে জানান, সদর উপজেলার ১৫ ইউনিয়নের সিংহভাগ ইউনিয়নে প্রকল্পগুলোর কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়নি। কোথাও একই স্থানে দ্বৈত (ডাবল) প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, কোথাও আবার শুধু নামমাত্র কাজ শেষ করে বিল উত্তোলন করা হয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, কর্তৃপক্ষের কথার সাথে বাস্তবতার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীরা জানান, প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সাধারণ মানুষ প্রত্যাশিত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গ্রামীণ রাস্তা, কালভার্ড সংস্কার, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, খাল খননসহ যেসব কাজের মাধ্যমে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেসব বাস্তবায়ন না হওয়ায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ভোগান্তি আরো বেড়েছে। স্থানীয় সচেতন মহল বলেন, ‘সরকারি অর্থে নেওয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হলে গ্রামীণ যোগাযোগ ও অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন হতো। কিন্তু অনিয়ম, দুর্নীতি ও দায়সারা কাজের কারণে সেই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তারা অবিলম্বে এসব অনিয়ম তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আমাদের প্রত্যাশা।’

অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, শিরখাড়া ইউপি সচিব মো: কবিরউদ্দিন হাওলাদারের স্ত্রীর নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান খুলে ৩টি ওয়ার্ড থেতে নিয়েছে একাধিক কাজের বরাদ্দ। সে সব প্রকল্পের বিল উত্তোলনও করে নিয়েছেন। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি ওই এলাকার জনগণ। এই ইউনিয়নে জুলাই বিপ্লবের পর ১১ মাস চেয়ারম্যান ছিলো না। শূণ্য এই পদের বিপরিতে সকল প্রকার আর্থিক লেনদেন বন্ধ থাকার কথা থাকলেও অদৃশ্য এক শক্তির বলে থেমে থাকেনি আর্থিক লেনদেন ও প্রকল্পের বিল উত্তোলন প্রক্রিয়া। নথীপত্রে দেখা যায়, সচিব কবিরউদ্দিন হাওলাদার ২৬ বছর চাকরীর জীবণে মাঝে মাঝে একাধিকবার বদলী হলেও ঘুরে ফিরে শিরখাড়া ইউনিয়নেই কেটেছে দীর্ঘ ১৫ বছর। এ বিষয়ে জানতে তাকে একাধিকবার মোবাইল যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিফ করেননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিভিন্ন ইউনিয়নের মেম্বাররা বলেন, ‘প্রকল্প পাওয়ার পরে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয় সচিবকে।’ আর সচিবরা বলেন, ‘প্রকল্পের ১০% দিতে হয় অফিসের উর্ধতন কর্মকর্তাদের ।’ এতে একে অপরের সাথে যে টাকার ভাগাভাগির খেলা হচ্ছে তা নিয়ে জনমনে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সবকিছু জেনে-শুনেও মনে হচ্ছে কর্তৃপক্ষ কিছুই জানে না। অথচ, এসকল অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে উর্ধতন কর্তৃপক্ষ এবং প্রভাবশালী মহলের যোগসাজসে। চলমান এসব পুকুর চুরির ঘটনা প্রকাশ্যে এলেও সরকারের উপর মহলে কোন সাড়া নেই। শিরখাড়া ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডে একটি পারিবারিক কবরকে গণকবর দেখিয়ে ৫.৬ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। যার বাজার মূল্য ৩লাখ ১৫হাজার টাকা। এ বিষয়টি নিয়ে এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। পারিবারিক কবরকে গণকবর দেখানো প্রচলিত আইনের পরিপন্থি। এ বিষয়ে এলাকাবাসী কিছুই জানে না।

১নং ওয়ার্ডের গোসাইদিয়া গ্রামের সিরাজুল হক মাস্টার বলেন, “আপনারা যে ব্যাপারে আসছেন, সালাম হালদারের বাড়ির কবরস্থানটি তার পারিবারিক কবরস্থান। ইতিপূর্বে সেখানে সালাম হালদারের বাবা ও দুই ভাইকে দাফন করা হয়েছে, পরে তার ভাই সোলেমানকেও সেখানে দাফন করা হয়। এলাকার অন্য কোন ব্যক্তির মরদেহ সেখানে দাফন করা হননি। গণকবরের নামে সরকার বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বিগত দিনে অনেক টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু এসবের মাধ্যমে সরকার ও জনগণ উভয়ই হয়রানির শিকার হচ্ছে। এটি স্পষ্টভাবে একটি আত্মসাৎমূলক কাজ। ভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনা আর না ঘটে, সে জন্য আমরা সরকারের কাছে কঠোর তদন্ত ও পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করছি।’

সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়নের হালিম মাতুব্বর বলেন, ‘৭নং ওয়ার্ডের বল¬ভদি গ্রামের ফকির বাড়ির রাস্তাটি ৫বছর আগে হয়েছে। আগের বিছানো ইট এখনো রয়েছে। নতুন করে এখানে আর কোন কাজই হয়নি। অথচ শুনলাম এই রাস্তা সংস্কারের জন্য একটি প্রকল্প বরাদ্দ হয়েছে।’ একই ইউপির ৫নং ওয়ার্ডের জামাল বেপারী বলেন, ‘আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, এটি বাবুল শেখের বাড়ি। এই বাড়ির সংলগ্ন পাকা রাস্তা থেকে সেলিম কারিগরের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুননির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু তিন বছর আগে শুধু ইট বসানো হয়েছিল, এরপর আর কোনো কাজ হয়নি।”

মস্তফাপুর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আমির হোসেন বলেন, ‘বড় বাড্ডা আবুল হাওলাদারের মসজিদ থেকে করম আলী ফকিরের বাড়ির অভিমুখে যে রাস্তা রয়েছে, সেটি দীর্ঘদিন ধরে নিম্নমানের ও চলাচলের অযোগ্য অবস্থায় পড়ে আছে। কিছুটা ব্যবহার উপযোগী করতে গ্রামবাসী মাটি ফেলে অস্থায়ীভাবে পথ তৈরি করেছেন। রাস্তাটি এতটাই খারাপ যে, একটি ভ্যানগাড়ি চলাচল করতেও কষ্ট হয়। তিনি আরও বলেন, এমন পরিস্থিতিতে একবার গর্ভবতী মাকে হাসপাতালে নিতে গিয়ে বাচ্চার মৃত্যুও হয়েছে। এ পর্যন্ত এই রাস্তায় কোনো সরকারি কাজ হয়নি। তাই আমরা দ্রুত রাস্তাটির নির্মাণ ও সংস্কারের দাবি জানাই। আর সরকার আমাদের উন্নয়নের জন্য কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে, সেই টাকা চলে যাচ্ছে দুনীতিবাজদের পকেটে।’

আমির হোসেনের অভিযোগের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। অফিস থেকে পাওয়া কাগজপত্রে দেখা যায়, বড় বাড্ডা আবুল হাওলাদার মসজিদ থেকে করম আলী ফকিরের বাড়ির অভিমুখের রাস্তাটি ভূমি হস্তান্তর করের ১% অর্থ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪লাখ ২৩হাজার টাকা বরাদ্দ ছিল। নথির তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, এ অর্থ ইতোমধ্যেই উত্তোলন করা হয়েছে। এই রাস্তার ব্যাপারে এখানেই শেষ নয়। এই একই রাস্তা ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ৬লাখ ৭১হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিলো। তখনো কোন কাজ করা হয়নি। সেই সব টাকা গেলো কোথায়?

এদিকে ৩ নং ওয়ার্ডের মেম্বার জিয়া দেশের বাইরে থাকায় কথা হয় তার বড় ভাই কুদ্দছ হাওলাদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই রাস্তাটির জন্য সত্যিই বরাদ্দ এসেছে, আমার ভাইও তা জানে না। কিন্তু আমার ভাই এই ওয়ার্ডের মেম্বার হয়েও কোনো কাজ পাচ্ছে না, কাজ পায় সাবেক মেম্বার আবুল হাওলাদার। এদিকে আবুল হাওলাদারের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘এতো টাকা বরাদ্দ হয়েছে তা আমিও জানি না। আমি একবার ৩০হাজার টাকা পেয়েছিলাম, লেবার খরচ দিয়ে আমার ৫০হাজার টাকা খরচ হয়েছিলো।’ ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে আবার বরাদ্দ আসে ৪লাখ ২৩ হাজার টাকা। নতুন করে রাস্তা হবে বলে ওই এলাকার বাসিন্দাদের গাছপালা কেটে, গোয়াল ঘর ও রান্না ঘর ভেঙ্গে পরিস্কার করা হয়। কিন্তু এলাকাবাসী সেই রাস্তার মুখ আজো দেখেনি। অথচ নথীপত্রে দেখা যায়, একই রাস্তায় দুইটি অর্থ বছরে দুইবার বরাদ্দ হয়েছে। এলাকাবাসীর প্রশ্ন তাহলে সরকারের এই টাকাগুলো গেলো কোথায়?

অন্যদিকে শহরতলীর পাশে রাস্তি ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর তালুকদার বলেন, ‘আমাদের এই ওয়ার্ডটি বহুদিন ধরে অবহেলিত। সরকার আসে, সরকার যায়, কিন্তু, এই রাস্তার কোনো উন্নয়ন হয় না।’ পশ্বিম হাজারাপুর গ্রামের এচাহাক ফকিরের বাড়ী হতে সাজু আকনের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা হবে হবে করে আর হয় নাই। পাঁচ বছর আগে মাটি ফেলা হয়েছিল, এরপর থেকে আর এক কোদাল মাটিও ফেলা হয়নি। আমরা বারবার দাবি জানালেও এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আমরা চাই দ্রুত এই রাস্তা সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া হোক। জনগণের চলাচলের জন্য এটি একান্ত প্রয়োজন।” একই ইউনিয়নের বাসিন্দা শিশির হাওলাদার বলেন, ‘আমার বাবার নাম দবির হাওলাদার। তাই আমাদের বাড়ির সামনে থেকে কুদ্দুছ শিকদারের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তাটি পূণ:নির্মিাণ হওয়ার কথা। এই রাস্তা দিয়ে অসংখ্য মানুষ চলাচল করে। কিন্তু রাস্তাটি সংস্কার করা হয়নি। আমরা চাই রাস্তাটি সংস্কার করা হোক।’

২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১% প্রকল্পের আওতায় খোয়াজপুর ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডে আনু উকিলের বাড়ি থেকে মধ্যচক শেকান খানের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তায় ইটের সলিংয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা। একই ঠিকানা দেখিয়ে পাঁচখোলা ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডেও দেয়া হয় আরও ৫ লাখ টাকার বরাদ্দ। কিন্তু, এক ঠিকানা দুই ইউনিয়ন দেখিয়ে প্রকল্পের অর্থ উত্তোলন করা হলেও হয়নি কাজের কোনো বাস্তব অগ্রগতি। এ যেনো এক আত্মভোলা শিশু চুরির খেলা।

একই অর্থবছরের প্রথম পর্যায়ে মাদারীপুর সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডে কুনিয়া মাহামুদসী এলজিইডি রোড থেকে মিয়া বাড়ি পর্যন্ত মাটির রাস্তাা নির্মাণের জন্য ৬ লাখ ৩৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ওই স্থানে বহু আগেই নির্মিত একটি ইটের রাস্তা রয়েছে।

কুনিয়া ইউনিয়নের সংরক্ষিত ১নং ওয়ার্ডের মহিলা মোছা: রোজিনা বেগম বলেন, ‘২ নং ওয়ার্ডের এলজিইডি রাস্তা থেকে মাহমুদসী হাজী বাড়ি পর্যন্ত, সেখান থেকে মিয়া বাড়ির ঘাট, এবং মিয়া বাড়ি থেকে সাগর হালাদার এর বাড়ি পর্যন্ত প্রায় ৭ বছর আগে এই রাস্তায় ইট বসানো হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সেই রাস্তা ভেঙে গেছে। জনগণ প্রতিদিন চরম কষ্টে চলাচল করছে। অসুস্থ রোগীদের খাটে করে নিতে হয়, যা অত্যন্ত কষ্টদায়ক। আমি সরকারের দায়িত্বশীল ও মূল্যবান ব্যক্তিদের কাছে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি আমাদের এই রাস্তাটি দ্রুত সংস্কার করার ব্যবস্থা করুন। শুনেছি, এই রাস্তার জন্য প্রায় ৬ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো কাজ হয়নি। টাকা কোথায় গেছে, বা কাজটি কেন বন্ধ রয়েছে, আমরা কিছুই জানি না।’

এদিকে মাদারীপুর সদর উপজেলার পাঁচখোলা ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডে ১% প্রকল্পের আওতায় রেজাউল কাজীর বাড়ি থেকে জাহাঙ্গীর ফকিরের জমি পর্যন্ত মাটির রাস্তা নির্মাণের জন্য ২লাখ ৫০হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ওই ওয়ার্ডে এই নামে এমন কোনো রাস্তা পাওয়া যায়নি। এলাকাবাসী জানে না যে, এই নামে এলাকায় কোন লোক আছে।

মাদারীপুর সদর উপজেলার ১৫ ইউনিয়নে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার ও পূণ:নির্মাণের জন্য সরকার থেকে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প প্রণয়ন করা হলো এবং প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য টাকা ছাড় দেওয়া হলো, এসব এলাকার সাধারণ মানুষ জানতেও পারলো না বরাদ্দের কথা এবং কোটি কোটি টাকার বিল উত্তোলনের বিষয়টি। তাহলে এই বিপুল অংকের টাকার বিল উত্তোলন করে আত্মসাৎ করলো কে বা কারা? সরকারী বিধানে আছে এইসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলো কি না তা দেখভালের দায়িত্ব ছিলো উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার।

এ ব্যাপারে বিভিন্ন ইউনিয়নের সাধারণ মানূষ অতীষ্ট হয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিয়ে কোন প্রতিকার না পেয়ে অবশেষে দুর্নীতি দমন কমিশনের শরণাপন্ন হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক অভিযোগ পেয়ে গত ৩০ সেপ্টেম্বর উপজেলা পিআইও অফিসে এবং উপজেলা প্রকৌশলীর (এলজিইডি) কার্যলয়ে অভিযান পরিচালনা করে। তারা ওইসব অফিসের নথীপত্র যাচাই-বাছাই করে ১৫ ইউনিয়নের ১১টি ইউনিয়নে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির সত্যতা পাওয়া গেছে বলে সরকারী সমন্বিত ভবনে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের উপ-পরিচালক মো: আখতারুজ্জামান জানান।

এ ব্যাপারে সদর উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ‘এসব বিষয়ে স্পেসিফিক বলতে হলে কাগজপত্র দেখে বলতে হবে।’ বাংলা এডিশন থেকে তার কাছে প্রশ্ন করা হয়, প্রকল্প দেওয়ার পরে আপনারা যে, মেম্বার-সচিবদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ নেন এটা কিসের জন্য নিয়ে থাকেন?’ তিনি এই প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারেননি।

মাদারীপুর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াদিয়া শাবাব বলেন, আমার বিষয় যেসকল অভিযোগ আনা হয়ে গেছে এগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

এ ব্যাপারে মাদারীপুর জেলা প্রশাসক অফিসের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক (উপ-সচিব) মো: হাবিবুল আলম বলেন, ‘২০২৪-২৫ অর্থ বছরে বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে টিআর ও কাবিখা, কাবিটা, ১% এর বেশি প্রকল্প দেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পের কাজগুলোতে অনিয়মের অভিযোগ পাচ্ছি। এ কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকায় উপজেলা পিআইও, ইউনিয়ন ইঞ্জিনিয়ার ও উপজেলা ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়ে তদন্ত করাচ্ছি। আমি নিজেও বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছি। তদন্তের রিপোর্ট এখনও হাতে এসে পৌঁছায়নি। রিপোর্ট হাতে এলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। যদি কোথাও একই কর্মসূচির জন্য একই রাস্তার ওপর দ্বৈতভাবে (ডাবল) প্রকল্প দেওয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে প্রকল্প বাতিল করে অর্থ ফেরত নিয়ে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হবে। আর যেখানে সরেজমিনে কোনো কাজ হয়নি, সেসব প্রকল্প শনাক্ত করা হবে। এ ধরণের অর্থ আত্মসাতে যে সব ব্যক্তি জড়িত থাকবেন, তাদের বিরুদ্ধে অফিসিয়ালি আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’



banner close
banner close