রবিবার

১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

বান্দরবানের পর্যটন এলাকায় চল‌ছে বন্যপ্রাণী শিকার ও পাঁচার

বান্দরবান প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ৬ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:৫৮

শেয়ার

বান্দরবানের পর্যটন এলাকায় চল‌ছে বন্যপ্রাণী শিকার ও পাঁচার
ছবি: বাংলা এডিশন

বান্দরবানের অন্যতম পর্যটন স্পট প্রান্তিকলেক ও কদুখোলা এলাকায় খাস পতিত পাহাড়, সরকারি সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও বান্দরবান সীমান্ত লাগোয়া চট্টগ্রামের বনবিভাগের রিজার্ভ ফরেস্টের গাছ ও বিশেষ জালসহ নানা ধর‌নের ফাঁদ পেতে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, বন্যপ্রাণী শিকার এবং জীবিত বন্দি করে বাহিরে পাঁচারের অভিযোগ উঠেছে একটি সংঘবদ্ধ রো‌হিঙ্গা ‌সি‌ন্ডি‌কেট চক্রের বিরুদ্ধে। এছাড়া এ চক্রটি সরকারী বনভূ‌মি ও সরকারী খাস জ‌মির বি‌র্স্তীণ এলাকা দখল ক‌রে ‌নি‌য়ে‌ছে।

স্থানীয়রা জানায়, এ চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে রাতের আধাঁরে অবাধে সরকারি সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও উক্ত বনবিভাগের রিজার্ভ ফরেস্টের বিভিন্ন প্রজাতির মূল্যবান গাছ কেটে পাঁচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে উক্ত এলাকায় মাইলের পর মাইল বিস্তীর্ণ এলাকা বনাঞ্চল বৃক্ষশূন‌্য হয়ে পড়ছে। এছাড়াও নানা প্রজাতি পশুপাখি শিকার ক‌রে নিধন ও পাঁচার

এসব পাহাড় ও বনাঞ্চলের বন্যপ্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে বলে দাবী তা‌দের। তা‌দের ম‌তে, ৫/১০বছর যাবত এ চক্রটির কয়েকজন সদস্য প্রান্তিকলেক এলাকাস্থ সরকারি সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও পতিত খাস পাহাড়ের প্রায় ২০একরের অধিক জায়গায় সরকারের নিষিদ্ধকৃত পরিবেশ ক্ষতিকর ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছ লাগিয়ে ভূমি দখল করে নিয়েছে দখ‌লে রাখার জন‌্য না‌মে মাত্র ক‌য়েক‌টি অস্থায়ী ঘর বা‌নি‌য়ে রে‌খে‌ছে।

সরেজমিনে সুয়ালক ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড কদুখোলা ও প্রান্তিকলেকসহ আশপাশে এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, পতিত খাস পাহাড়, বনভূমি, বনাঞ্চল ও কালাইচ্ছাখোলা সীমানায় লাগোয়া চট্টগ্রামের বনবিভাগের রিজার্ভ ফরেস্ট এরিয়ার বি‌ভিন্ন স্থানে একাধিক অবৈধ বাড়ি ‌নির্মাণ করা হ‌য়ে‌ছে। বাড়ির চারপাশে রয়েছে সরকারের নিষিদ্ধকৃত ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি ছোটবড় গাছ, চারাগাছের একাধিক বাগান। ত‌বে বসতঘরগুলোতে কোন লোক ছিলনা।

কদুখোলার বাসিন্দা মেজবাহ উদ্দিন বলেন, একসময় এসব বনাঞ্চলে ময়না, হিল ময়না, টিয়া, রাজধনেশ, দোয়েল, মুতুরা, বন‌মোরগ, ঘুঘু, বনপায়রা, সাদাবক, কাক, কোকিল, শালিক, হরিয়াল, চড়ুই, কুড়াডগ, বনহাঁস, বাজপাখি, কোয়েল, চিল, পেঁচা, মাছরাঙা, ঈগল, কাঠঠোকরা, বুলবুলি, কাঠশালিক, বউকথাকও, পাতিহাঁস, বাবুইসহ প্রায় ৩৫-৪০ প্রজাতির পাখি এবং সাম্বার হরিণ, মায়া হরিণ, গয়াল, বুনো গরু, বন ছাগল, বনরুই, গন্ধগোকুল, বেজি, তক্ষক, ভোঁদড়, চিতাবিড়াল, লজ্জাবতী বানর, মেঘলা চিতা, মার্বেল চিতা, কালো ভালুক, উলু বানর, উল্লুক, লম্বা লেজি শজারু, হলুদ কচ্ছপ, বানর, লজ্জাবর্তী বানর, সজারো, বনশূকর, নেকড়ে বাঘ, বনশিয়াল, বনকুকুর (রাম কুকুর), কাঠবিড়ালি, বনবিড়াল, অজগর, লালপান্ডা, ২১ প্রজাতির ইঁদুরসহ বিভিন্ন সরীসৃপ প্রাণী দেখা যেত। কিন্তু এ সংঘবদ্ধ চক্রটি ফাঁদ পে‌তে এসব শিকার ও বন্দি করে পাঁচারের কারণে এসব বন্য প্রাণীগু‌লো আজ বিলুপ্তির পথে। তি‌নি আরো ব‌লেন, এখা‌নে তারা বনমোরগ, সাম্বার হরিণ, মায়া হরিণ, বুনোগয়াল, বুনোগরু, বুনোছাগল শিকার করে গ্রামেই আস্ত ও মাংস কে‌টে বিক্রি করে। একটি বনমোরগ ২-৩হাজার টাকা, হরিণ, বুনোগরু, গয়াল, বুনোছাগলের মাংস প্রতিকেজি দেড়, দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি করেন।

প্রান্তিকলেক এলাকার মুরুং পাড়ার বাসিন্দা রেংনিং ম্রো বলেন, এই এলাকায় ১২-১৩জনের সংঘবদ্ধ চক্র রয়েছে। চক্রের মূলহোতা সৈয়দ আলম, আব্দুল আলম ও শফিকুর ইসলাম। এরা বিগত ৮-১০বছর যাবত ঐলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও সরকারি বনাঞ্চল, পাহাড়, বনভূমি, বনবিভাগের বাগানের গাছ, কাঠ কেটে পাচারের পাশাপাশি পাখি, বিভিন্ন বন্যপ্রাণী হত্যা ও বন্দি করে বিক্রিসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে।

ঢাইক্কাখোলার কৃষক আব্দুল জালাল বলেন, পাখি ও বন্যপ্রাণী শিকার করার জন্য চক্রটির কাছে দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন অস্ত্র ও জীবিত বন্দী করার জাল, নানারকম ফাঁদপাতার যন্ত্র রয়েছে। এরা খুবই হিংস্র প্রকৃতির লোক। স্থানীয়দের সাথে প্রায় সময় ঝগড়া, বিবাদ, মারামারিসহ নানা অপকর্মে জড়ায়। স্থানীয়রা এদের ভয় পায়। তাই সহজে কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে চাই না।

কদুখোলার বাসিন্দা ছোলিম উল্লাহ বলেন, চক্রটির অধিকাংশ সদস্য মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে এই এলাকার মানুষের বাগান, চাষাবাদ জমি ও পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে এরা স্থানীয়দের সাথে ছেলে-মেয়ের বিয়েসাদী করিয়ে আত্মীয়তার মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে শক্তি অর্জন করে ফেলেছে। এসুযোগ কাজে লাগিয়ে, অর্থের বিনিময় ও নানা কৌশলে জাল কাগজ তৈরি করে বাংলাদেশের নাগরিকও হয়ে গেছে এরা।

একই এলাকার কৃষক আব্দুস ছালাম বলেন, পূর্বে যেসব রোহিঙ্গারা আসছে, এরা কৌশলে ভোটার হয়ে স্থানীয় বাসিন্দা হয়ে গেছে। পুরাতন ও নতুনরা মিলে পার্বত্য বান্দরবান জেলার পাহাড়, বনভূমি দখল করে বসতি স্থাপন, গাছ নিধন ও বন্যপ্রাণী হত্যা, পাঁচারসহ নানা অপকর্ম করছে।

পাহাড়, বনভূমি দখল, পাখি, বন্যপ্রাণী শিকার ও কাঠ পাচারের বিষয়টি স্বীকার করে সুয়ালক ইউনিয়নের কদুখোলা ৩নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য রফিকুল আলম জানান, চক্রটির কাছে শিকারী জাল, ফাঁদপাতার যন্ত্রসহ নানা দেশীয় অস্ত্র রয়েছে। এরা এতই কৌশলী যে, এসব অস্ত্র পাহাড়, জঙ্গলের ঝোপঝাড়ে ও মাটিতে বিশেষ কায়দায় গর্তে লুকিয়ে রাখেন। রাতের আধাঁরে ও জনমানব শূন্য এলাকায় এসব কাজে লাগান। অস্ত্র থাকায় স্থানীয়রাও ভয় পায় তাদের। বিভিন্ন সময় আইন-শৃঙ্খলার বাহিনী অভিযান চালালেও তাদের কৌশলের কারণে এসব উদ্ধার করা যাচ্ছে না। চক্রটির সদস্যরা পূর্বে রোহিঙ্গা নাগরিক ছিল বলে জানান এ ইউপি সদস্য।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোয়েন্দা সংস্থা এক গোয়েন্দা বলেন, ১৫-২০বছর আগে এসে যেসব রোহিঙ্গা সুয়ালকসহ বিভিন্ন এলাকায় মানুষের বাগান, জমিতে পাহারাদার ও চাষী হিসেবে আশ্রয় নেয়। এই এলাকায় দীর্ঘ বছর থাকার সুবাদে নানা কৌশলে এদেশের নাগরিক হয়ে গেছে। এরা বন্যপ্রাণী, কাঠ পাচার, চুরি-ডাকাতিসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত থাকার তথ্য রয়েছে আমারাদের কাছে। তদন্ত চলমান হলেও বিষয়টি জটিল আকার ধারণ করেছে।

এব্যাপারে বান্দরবান বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুর রহমান বলেন, বর্তমানে বন্যহাতি সংরক্ষণের জন্য একটি প্রকল্প চালু রয়েছে। তবে পাখিসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী হত্যা, পাঁচার রোধ ও অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করে যাচ্ছে বনবিভাগ। শীগ্রই এসব বন‌্যপ্রাণী নিধন পাঁচা‌রের সা‌থে জ‌ড়িত‌দের বিরু‌দ্ধে ব‌্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন তি‌নি।

বনাঞ্চল ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় এ চক্রের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনী ব্যবস্থা নিতে বনবিভাগ ও আইন-শৃঙ্খলার বাহিনী প্রতি আহবান জানিয়েছেন এলাকাবাসী।



banner close
banner close