রবিবার

১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৩০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

চাঁদপুরে সুদের টাকা লেনদেন নিয়ে গৃহবধুকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টা, অভিযুক্ত গ্রেপ্তার

চাঁদপুর প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ২২:০৫

শেয়ার

চাঁদপুরে সুদের টাকা লেনদেন নিয়ে গৃহবধুকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টা, অভিযুক্ত গ্রেপ্তার
ছবি: বাংলা এডিশন

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে সুদের টাকা লেনদেন নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধের জের ধরে শাহনাজ বেগম পাখি (৩৮) নামে গৃহবধুকে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনায় অভিযুক্ত সুদী কারবারি নাছিমা বেগমকে (৪২) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

শনিবার সন্ধ্যায় এই ঘটনায় গৃহবধুর মা হাজেরা বেগম নাছিমাসহ অজ্ঞাতনামা ২ থেকে ৩জনকে আসামী করে ফরিদগঞ্জ থানায় মামলা করেছে।

সন্ধ্যায় এসব তথ্য নিশ্চিত করেন ফরিদগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহ্ আলম।

বিকেলে সরেজমিন ঘটনাস্থল উপজেলার পাইকপাড়া উত্তর ইউনিয়নের উপাদিক খান বাড়িতে গিয়ে কথা হয় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বাড়ির লোকজন ও স্বজনদের সাথে।

আগুনে পুড়ে যাওয়া পাখির স্বামী আমিন খান বলেন, শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে ৮টায় দিকে আমি বাড়ির পাশে দোকানে বসা ছিলাম। ওই সময় আমার ভগিনা শাকিল জানায় তার মামির গায়ে আগুন লেগেছে। তাৎক্ষনিক আমি বাড়িতে গিয়ে আমার স্ত্রীকে ঘরের পাশের পানির ডুবায় পড়ে থাকতে দেখি। তখন তার গায়ে কোন কাপড়া ছিলো না, আগুনে সব পুড়েগেছে। ওই অবস্থায় বাড়ির লোকজনের সহায়তায় স্ত্রীকে নিয়ে সদর হাসপাতালে আসি। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে রাতেই নিয়ে আসি জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। বর্তমানে চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছে তার শরীরের ৮০% পুড়েগেছে। সে এখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।

তিনি আরো বলেন, আমার স্ত্রী পাখির সাথে প্রতিবেশি প্রবাসী হাফেজ ফয়েজ আহাম্মদ এর স্ত্রী নাছিমা বেগম এর সুদে আনা টাকা পরিশোধ নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ। এসব বিষয় নিয়ে কয়েকবার বৈঠক হয়েছে। এরপূর্বেও নাছিমা আমার স্ত্রীকে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করে এবং হুমকি-ধমকি দেয়। এসব ঘটনায় নিয়ে আমার স্ত্রী আদালতে মামলা করেছে। ওই মামলাও চলমান। এরপর নাছিমার তার লোকজনসহ সর্বশেষ পাখির হাত পা বেধে গায়ে কেরোসিন ডেলে হত্যাচেষ্টা করে।

ওই বাড়ির নরুল ইসলাম খানের স্ত্রী মেহেরুন্নেছা বলেন, ঘটনার সময় আমার ঘরের লোকজন চিৎকার শুনে এবং আমিনের ঘরে আগুন দেখে। আমি দ্রুত এসে দেখি আমিনের রান্না ঘরে আগুন। আগুন নেবানোর পর পাখির মেয়ে সুমাই জানায় তার মা নেই। পাখি ওই সময় প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিয়ে ঘর থেকে নামে। সুমাইয়া একটু সামনে গিয়ে দেখে রান্না ঘরের পাশের ডোবার পানির মধ্যে পড়ে আছে। তখন লোকজন জড়ো হয় এবং পাখির শরীর ছিলো মুরগী চোলার মত। সে বলছিলো আমাকে বাঁচান। পরে তার স্বামী আমিন এসে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

স্থানীয় সংরক্ষিত ইউপি সদস্য এবং ওই বাড়ির বাসিন্দা নুরজাহান বেগম বলেন, ঘটনার সময় আমি জেনেছি পাখির গায়ে আগুন দেয়া হয়েছে। তবে আমি অসুস্থ থাকায় আসতে পারিনি। সকালে এসে ঘটনা জানলাম। আমার জানামতে পাখি আর নাছিমা আপন বোনের মত সম্পর্ক ছিলো। টাকা লেনদেন নিয়ে বাড়ির লোকসহ আরোক কয়েকজন বসে স্ট্যাম্পে লেনদেনের সকল টাকা পরিশোধ করে দিয়েছি। এর বাহিরে কোন লেনদেনের বিষয় আমরা জানিনা। তবে মৌখিক লেনদেন অনুযায়ি নাছিমা আরো ৫৩ হাজার টাকা পায় বলে জানাতে পারি।

ইউনিয়নের ১নম্বর ওয়ার্ড ইউপি সদস্য আব্দুল হামিদ বলেন, ঘটনার পরেই পাখির স্বামী আমিন আমাকে জানায় তার স্ত্রীর গায়ে এবার আগুন দিয়েছে। আমি তাকে চিকিৎসার জন্য চাঁদপুরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলি। পরবর্তীতে আজ শনিবার বিকেলে ঢাকা থেকে ফোন করে আমিন জানায় তার কাছে কোন টাকা নেই। স্ত্রীর জন্য ওষুধ কিনতে পারছেন না। বিষয়টি আমি ইউএনওকে জানালে তিনি আমিনের মোবাইল নম্বর নেন এবং সহায়তা করবেন বলে জানান। আমিন কয়েকজনের কাছে টাকা চেয়েও সহযোগিতা পায়নি।

তিনি আরো বলেন, সুদের টাকা নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদে বৈঠক হয়েছে। সেখানে আমরা দুটি স্ট্যাম্প পাই। একটিতে ২৫ হাজার টাকা। ওই ২৫হাজার টাকা সুদসহ পাখি ৩০ হাজার টাকা পরিশোধ করে। আরেকটিতে পাই ৫০হাজার টাকা। এই টাকার সুদ ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে। তবে নাছিমা আমাদের কাছে বলে পাখি আরো দুই লাখ নিয়েছে। ওই টাকার পরিমান সাদা কাগজে লেখা রয়েছে। তবে ওই কাগজে যাদের স্বাক্ষী করা হয়েছে তারা বলেছেন, তারা টাকা লেনদেন সম্পর্কে কিছুই জানেন না এবং তাদের সামনে লেনদেন হয়নি।

স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমান জানান, নাছিমা ও পাখির লেনদেন দিয়ে এলাকায় একাধিক সালিশ বৈঠক হয়েছে। নাছিমা শুধুমাত্র পাখির সাথে নয়, সুদের কারবার নিয়ে তার সাথে অন্যদেরও বিরোধ হয়েছে। এরপূর্বেও পাখির ঘরে রাতে ইটপাটকেল মারে। হাত-পা বেধে হত্যার চেষ্টা করে। এসব কথা পাখি আমাদেরকে জানিয়েছে। নাছিমার এমন অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে স্থানীয় লোকজন কয়েকদিন আগে এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করে।

নাছিমার প্রতিবেশি আব্দুর রহমানের ছেলে ইলিয়াছ জানান, নাছিমার বাড়ি পাশবর্তী সানকির গ্রামের। সে এখানে এসে বাড়ি করেছে। আসার পর থেকে সুদিকারবার নানা সমস্যা সৃষ্টি করে আসছে। আমাদের সাথে নাছিমার সম্পত্তির বিরোধছিলো। এ পর্যন্ত সে আমাদের বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা করেছে।

অভিযুক্ত নাছিমার মা মমিনা বেগম বলেন, তিনিও মেয়ের সাথে এই বাড়িতে থাকেন। মেয়ে জামাতা ফয়েজ ও দুই নাতি থাকেন প্রবাসে। গতকাল সন্ধ্যায় তার মেয়ে নাছিমা বাড়ি থেকে বের হয়েছেন কাজে। রাতে একবার এসে আবার চলে যান। ওই বাড়ির ঘটনার পর তার মেয়ের ঘরের চারপাশের জনালার গ্লাস ভাংচুর এবং দরজা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়েছে স্থানীয়রা। তিনি এই ঘটনায় অপরাধীর বিচার দাবী করেন।

ফরিদগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহ আলম বলেন, এই বিষয় জানার পর রাতেই ঘটনাস্থলে গিয়েছি। প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি সুদের টাকা লেনদেন নিয়ে পাখি ও নাছিমার মধ্যে বিরোধ। এসব ঘটনায় উভয়পক্ষের অভিযোগ আছে। পুলিশের একাধিক টীম পুরো ঘটনাটি তদন্ত করে দেখছে। পাখির মা বিকেলে মামলা করেছে। অভিযুক্ত নাছিমাকে গ্রেপ্তার করে চাঁদপুর আদালতে সোপর্দ করেছি।



banner close
banner close