রবিবার

১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৩০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

ডোমার থানার ওসির বিতর্কিত কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা

নীলফামারী প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১৯:৩০

শেয়ার

ডোমার থানার ওসির বিতর্কিত কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা
ছবি: বাংলা এডিশন

ডোমার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আরিফুল ইসলাম এর বিরুদ্ধে বিএনপির অঙ্গ সংগঠন নিয়ে কটুক্তি, মামলার বিনিময়ে অর্থ বানিজ্য, সেবা প্রত্যাসীদের সাথে অসৌজন্য মূলক আচরণ, মাদক ব্যবসায়ীদের পক্ষে অবস্থান, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সুযোগ-সুবিধা দেয়ার অভিযোগ সহ তার বিরুদ্ধে নানান অপকর্মের অভিযোগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও এলাকাজুড়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। এর মধ্যে ওসির অপসারন ও শাস্তির দাবীতে বিক্ষোভ, মানববন্ধন সহ ঝাড়ু মিছিল সহ নানান কর্মসূচি পালন করেছে স্থানীয়রা।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একাধিক ভিডিওতে তার এসব বিতর্কিত কর্মকান্ডের চিত্র ফুটে উঠেছে। যা নিয়ে জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় অনেকে জানান একজন দ্বায়ীত্বশীল ব্যক্তির এমন কর্মকান্ড ভুল বার্তা দেয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলোর মধ্যে একটি ভিডিওতে দেখা যায় ডোমার থানার ওসি বিএনপির অঙ্গ সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রতি কটুক্তি ও হুমকির ভাষা ব্যবহার করছেন। ভিডিওটি নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

ভিডিওতে থানায় ধুমপানরত অবস্থায় স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতার উদ্দেশ্যে বলতে শুনা যায়, "আমি যেমন হিরো বানাইতে পারি তেমন জিরো বানাইতে পারি। নেতা কিন্তু বানায় পুলিশ। যদি ভবিষ্যতে কোনো প্লান থাকে তাহলে কিন্তু একদম জিরোতে নামাই দেব। করে তো স্বচ্ছাসেবক দল আর ভাব নেয় ওসির উপর দিয়ে, বাটাম খুলে দেব একদম। এই স্বচ্ছাসেবক দলটাই কিন্তু বেশী মাঠে গ্যাঞ্জাম করছে। আমি কিন্তু আপনাদের চাইতে বেশী পলেটিক্স জানি। আমি বুকে নিতে পারলে কিন্তু ছুড়েও মারতে পারি।"

আরেক ভিডিতে দেখা যায়, নিজ নামে টিকটক খুলে সিগারেট খাওয়া সহ নানান বিষয়ে ভিডিও আপলোড করেন ওসি আরিফুল। তার নামের টিকটক আইডির শর্ট ভিডিতে অভিনয় করতে দেখা যায়, "জীবনে আপনি বিড়ি কয়টা খাইছেন? সেই ভিডিওতে ওসি ঠোট মিলিয়ে বলে, বিড়ি আমি একটাও খাইনি বাপু। গরীব মানুষ টাকা পয়সা নাই, তাই সিগারেট খাই। এরপর এক হাতে সিগারেট এর প্যাকেট ভিডিওতে তুলে ধরেন। টিকটক আইডির বিষয়টি জানাজানি হলে সেই আইডি লক করে রাখেন ওই ওসি।

সেবা প্রত্যাশীরা ওসির সাথে ঘুষ লেনদেন সহ নানা বিষয়ে অভিযোগ তুলে ধরেন। এনায়েত কবির নামের এক ব্যক্তি পারিবারিক একটি সমস্যা নিয়ে থানায় গেলে তাকে দেখেই ওসি তার উপর ক্ষিপ্ত হয়। এসময় ক্ষিপ্ত হয়ে ওসি রাগান্নিত বাসায় ওই ব্যক্তিকে বলেন, আপনি থানায় কেন বের হন মিয়া, আপনি কেন থানায় আসছেন। এ সময় ব্যক্তি কথা বলতে চাইলে তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অপমান করে জোড়পূর্বক থানা থেকে বের করে দেন।

এ বিষয়ে এনায়েত কবির জানান, ওসির এমন আচরনের কারনে আমি হতাশ ও অপমানিত হয়ে থানা থেকে বের হয়ে আসি। এরপর নীলফামারীর এসপি স্যারের সাথে যোগাযোগ করি, তিনি আমাকে অনলাইনে জিডি করার পরামর্শ দেন। ডোমার থানার ওসি আরিফুল ইসলাম এর আচরন আওয়ামী ফ্যাসিবাদীর মতো তাই তিনি শেখ হাসিনার দোসর উল্লেখ করে ওসির শাস্তি দাবী করেন।

আরেক ভুক্তভোগী ডোমার সদর ইউনিয়নের এক দম্পতি স্কুলে পড়ুয়া তাদের নাবালিকা মেয়েকে উদ্ধার ও আইনি সহায়তা চেয়ে থানায় অভিযোগ করেন। ডোমার থানার ওসি তাদের সঙ্গে কথা না শেষ করে গালাগালি করে থানা থেকে বের করে দেন। দম্পতিরা বলেন, তাদের মেয়ে (৮ম শ্রেণীর) স্কুল ছাত্রী প্রেমের সম্পর্কের জেরে একটি ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছে বলে তারা থানায় অভিযোগ দায়ের করতে গিয়েছিলেন।

তারা দাবি করেছেন, ঘটনার সময় কৌসলে ওসির কথাগুলো ফোনে রেকর্ড করেছেন; রেকর্ডিংয়ে ওসিকে বলতে শোনা যায়, “এই ব্যাপারটা আমি জানি, প্রেমের সম্পর্কের কোনো ভিত্তি নাই। আপনারা থানা থেকে বের হয়ে যান, আমার থানায় যেন আপনাদের না দেখি।” পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের সহায়তায় ওই দম্পতির অভিযোগ গ্রহণ করা হয় বলে তারা জানান।

শুধু সাধারণ সেবা প্রত্যাশী বাক্তিদের সাথে এমন ঘটনা নয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতাদের সামনেও থানায় ওসি তার অফিসে বসে ধুমপান করে কথা বলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের অভিযোগ, থানার ওসি দায়িত্ব পালনের সময় ধূমপান করেন এবং বহুবার মেজাজ হারিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একজন থানার ওসি জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করবেন, কিন্তু তিনি যদি জনগণকে অপমান করেন এবং সামাজিক নিয়ম ভঙ্গ করেন, তবে জনগণের আস্থা নষ্ট হবে। আমরা প্রশাসনের নিকট জোর দাবি জানাই, এ বিষয়ে দ্রুত তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডোমার উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা জানান, এবারের ঈদে ডোমার সদর, হরিনচড়া ও বোড়াগাড়ি—এই তিনটি ইউনিয়নের আওয়ামীলীগ সমর্থিত চেয়ারম্যানদের কল দিয়ে টাকা দাবি করেন ডোমার থানার ওসি আরিফুল ইসলাম। তবে টাকার বিনিময়ে ওই তিন আওয়ামীলীগের চেয়ারম্যানকে নিজ নিজ বাড়িতে থেকে তিন দিন ধরে ঈদ করার সুযোগ করে দেন তিনি। এতে প্রত্যেকে ৩০ হাজার টাকা করে মোট ৯০ হাজার টাকা ওসিকে প্রদান করেছেন বলে অভিযোগ করেন ওই নেতা।

তার ভাষ্যমতে, ডোমারের ওসি আশ্বাস দিয়েছেন যে র‌্যাব, পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থার বিষয়গুলো তিনি টাকার বিনিময়ে সামাল দেবেন। আরও অভিযোগ করা হয়, টাকার বিনিময়ে দীর্ঘদিন ধরে ডোমার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তোফায়েল আহম্মেদকে গ্রেফতার না করে এলাকায় প্রকাশ্যে চলাফেরার সুযোগ দিয়েছেন ওসি আরিফুল।

আমিনুর রহমান নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, “জমি নিয়ে পারিবারিক বিরোধের ঘটনায় ডোমার থানায় মামলা করতে যাই। প্রথমে ওসি মামলা রেকর্ড করতে নারাজ। ওসি প্রস্তাবে ১০ হাজার টাকা দিয়ে মামলা রেকর্ড হয় কিন্তু এরপরেও মামলা করার পর পুলিশ খরচের কথা বলে আমাদের কাছ থেকে আবারও টাকা নিয়েছে।"

প্রশাসনের গোয়েন্দা শাখার এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি আরিফুলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, একটা কাজে ডোমার থানায় গিয়েছিলাম আমাদের কাজের পূর্বে সরাসরি বস্তা ভর্তি টাকার আবদার করে ওসি আরিফুল।

ডোমারের একাধীক সাংবাদিক অভিযোগ করেন পুলিশের পোষাকে ওসির চেয়ারে বসে প্রকাশ্যে ধুমপান ও মেজাজের ভারসাম্য হারিয়ে প্রায় সময় খারাপ আচরণ করেন।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর ওসি আরিফুল ইসলামের অপসারণ ও শাস্তির দাবী প্রসঙ্গে ডোমার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে নীলফামারী পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করছেন এলাকাবাসী। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ডোমার থানা কর্মরত ঘুষখোর অফিসার ইনচার্জ আরিফুল ইসলাম ডোমার থানায় যোগদানের পর থেকে নানামুখী অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে। তিনি বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে মাসহারা আদায় ও না দিলে হয়রানী হুমকি, মামলা নথিভুক্ত করতে ঘুষ গ্রহণ সহ নানা অনিয়মকে নিয়মে পরিনত করেছে। এতে একদিকে সেবা প্রার্থীরা যেমন হয়রানীর স্বীকার হচ্ছে অপর দিকে ভুক্তভুগির পকেট কেটে ওসি হচ্ছে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। ২৪শে'র স্বাধীনতার পরে একজন ওসির এমন কর্মকান্ড সত্যি লজ্জাজনক।

আরও উল্লেখ থাকে এদেশে মাদক একটি ভয়াবহ সমস্যা ও সামাজিক ব্যধি, ডোমার এর ব্যতিক্রম নয়। ডোমার পৌরসভার কাজীপাড়া মাদক সম্রাজ্ঞী রুপার বাড়ী এর অন্যতম ঘাটি। এই ওসি ডোমার থানায় যোগদানের পর হতে মাদক সেবন, বিক্রি, অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে। বিভিন্ন মহল থেকে তাকে এ বিষয়ে একাধিকবার পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয় বললেও তিনি তা এড়িয়ে গেছেন। লোক দেখানো কিছু চুনোপুটি মাদক কারবারীকে গ্রেফতার করে নিজেকে করিৎকর্মা প্রামানের চেষ্টা করছেন। মাদক নির্মূলে সচতন মহল ওসির সহযোগিতা চাইলে তিনি তাদের চুঙ্গিখোর, মব সৃষ্টিকারী আখ্যা দিয়ে হেও প্রতিপন্ন করে মামলা দেয়ার হুমকি দেন।

এ ঘটনার ভুক্তভোগী স্থানীয় সাংবাদিক আসাদুজ্জামান হিল্লোল জানান, ডোমার কাজীপাড়া এলাকায় কুখ্যাত মাদক সম্রাজ্ঞী খ্যাত রুপা নামের এক মহিলা দীর্ঘদিন যাবত মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। তার এই অপকর্মের কারনের এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে উত্তেজিত হয়। গত ৫ বছর পূর্বে তার বেপরোয়া মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে এলাকাবাসী ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করলে সে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রশাসনের সহায়তায় ২৭ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ে করে। মামলার পর কয়েকমাস হয়রানী করার পর মিমাংসার মাধ্যমে মামলা তুলে নেয়।

সাংবাদিক হিল্লোল জানান, দিন দিন মাদক সম্রাজ্ঞী রুপা মাদক ব্যবসায় বেপরোয়া হয়ে উঠলে প্রশাসন তাকে বহুবার গ্রেফতার করে। কিন্তু নিমিষের জেল থেকে বের হয়ে আবারো মাদক ব্যবসায় নেমে পড়েন। তার এমন অপকর্মের কারনে এলাকার মানুষ অতিষ্ট। এলাকাবাসী গত সপ্তাহে রুপার বিরুদ্ধে আবারো ঐক্যবদ্ধ হয়, এ নিয়ে উত্তেজনা দেখে বিষয়টি ডোমার থানার ওসিকে মোবাইলে অবগত করলে তিনি আমাকে উল্টো ধমক দেন। ওসি বলেন, আপনি ও এলাকার মানুষজন মব সৃষ্টির কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা করলে এর দায় আপনাকে নিতে হবে। আইনি সহযোগিতার পরবর্তীতে উল্টো ওসি আমাকে হুমকি দিয়েছেন, এতে পরিষ্কার বোঝা যায় ওসি নিজেই মাদক ব্যবসায়ীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এ ঘটনা কে কেন্দ্র করে পরদিন এলাকাবাসী ডোমার থানার ওসির অপসারণ এর দাবিতে ঝাড়ু মিছিল করেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর উপজেলা সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ আইয়ুব বলেন, মাদকের কারনে আমরা এই এলাকার মানুষ সমাজে একেবারে ঘৃণিত হয়ে গেছি। তাই বাধ্য হয়ে এই এলাকার মানুষ ওসির অপসারনের দাবীতে ঝাড়ু নিয়ে মাঠে নেমেছে। কারন, এসব দেখার জন্য যার দ্বায়ীত্ব ওসি ও প্রশাসন তারা একেবারে নিশ্চুপ। প্রশাসন মাসোয়ারার বিনিময়ে অপরাধীদের সহযোগীতা করছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন।

ডোমার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আরিফুল ইসলাম জানান, কারো পাকা ধানে মই দিয়ে ক্ষতি করিনি। কেন যে আমার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে পেছনে লেগেছে তা বুঝলাম না। বদলীর চাকরী করি সময় হলে যেকোনো সময় চলে যেতে হবে।

ডোমার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শায়লা সাঈদ তন্বী জানান, এলাকাবাসী ডোমার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মো. আরিফুল ইসলাম বিরুদ্ধে শাস্তি ও অপসারনের দাবীর একটি লিখিত অভিযোগ আমার মাধ্যমে নীলফামারী পুলিশ সুপার বরাবর পৌঁছানোর জন্য জমা দিয়েছে। সার্কেল ওসিকে বিষয়টি অবগত করেছি এবং নীলফামারী পুলিশ সুপারের নিকট অভিযোগটি রবিবার পাঠানো হবে।

নীলফামারী পুলিশ সুপার এ.এফ.এম তারিক হোসেন খান জানান, অভিযোগ ডোমারের ইউএনও এর মাধ্যমে দিয়েছে এখনো হাতে পাইনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।



banner close
banner close