রবিবার

১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৩০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

বান্দরবানে জুমের ধান কাটা শুরু, পাহাড়ে লেগেছে সোনালী রং

বান্দরবান প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ০৭:০৯

আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ০৭:১৩

শেয়ার

বান্দরবানে জুমের ধান কাটা শুরু, পাহাড়ে লেগেছে সোনালী রং
বান্দরবানে জুমের ধান কাটা শুরু, পাহাড়ে লেগেছে সোনালী রং

সবুজ ঘেরা উচু নিচু ঢালু ভূমিতে পাহাড়ে পাহাড়ে, চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে,সোনালী রঙের রাংঙিয়ে ভরিয়ে আছে জুমের ধানের পাকা। পাহাড়ে অলিতে গলিতে সব জায়গায় এখন পাকা ধানের সৌরভ। তাই এই ধানের সৌরভ বলে দিচ্ছে নবান্নের উৎসবের আগমন ঘটতে আর বেশি দিন নেই। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরদের মনে এখন আনন্দের মাতোয়ারা। জুমের পাকা ধানের দৃশ্য দেখলে মনের দুঃখ কষ্টের কথা সব ভুলে যায় জুমিয়াদের। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরদের প্রধান উৎস হচ্ছে জুম চাষ। জুম চাষ পাহাড়িদের আদি পেশা। জুমের পাকা ধানের চাল দিয়ে চলে সারা বছরের খাদ্য।

ইদানীং পাহাড়ের জুমের ধান পেকেছে। উপযুক্ত হয়েছে নানারকম ফসল। তাইতো প্রতিটি পাহাড়ের ধুম পড়েছে জুমের ধান কাটার মহোৎসব। দেখা মিলছে পাকাধান কাটতে নারী-পুরুষ উভয় জুমচাষীদের। বর্তমানে এই দৃশ্যটি দেখা মিলেছে পাহাড়ে।

এপ্রিল মাসে শুরু দিকে জুমিয়ারা যেসব ধানের বীজ বপন করেছে সেসব ধান এখন কর্তনের আরম্ভ হয়েছে এবং এপ্রিল শেষের দিকে যারা বীজ বপন করেছে সেসব জুমের ধান পাকা কিছুটা বিলম্ব হতে দেখা দিয়েছে।

বান্দরবান জেলা থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক পাহাড়। সেই পাহাড়ের পাদদেশে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জামিনী পাড়ার কারবারি ৫০ বছর বয়সী মেনয়াং ম্রো, বছর দেড় আড়ি ধানের জুম চাষ করেছেন। সকাল থেকে পরিবারের জন সদস্য নিয়ে তিনি ধান কাটছেন। আবার কেউ কাটা ধানগুলোকে বড় থ্রুং দিয়ে বহন করে জুম ঘরে এসে সংগ্রহ করছেন।

বছরে জুমের ধান কেমন হয়েছে জানতে চাইলে জামিনী পাড়ার কারবারি মেনয়াং ম্রো বলেন, বছর তেমন ধান ভালো হয়নি। তাছাড়া জুমের জায়গা পাথর বেশি থাকার কারণে ধান ভাল হয়না। তাই শ্রমিক নিয়ে ধান কাটলে পুষাবেনা। সেজন্য স্ত্রী ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে ধান কাটা শুরু করেছেন। দেড় আড়ি ধান চাষ করেছেন, মাত্র ৩০ আড়ি ধান পাওয়ার আশা করছেন তিনি। তবে বছরের আবহাওয়া জুমিয়াদের জন্য খুবই উপযোগী বলে মনে করছেন তিনি। পর্যাপ্ত জমি না থাকাতে বেশি করে চাষাবাদ করতে পারছেননা বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বছরে যারা বড় জুম বা (/) আড়ি ধান চাষ করেছে তারা বেশি ধান পাবে বলে মন্তব্য করেন।

একই পাড়া নিবাসী রিংরাও ম্রো বছর ছয় আড়ি ধান রোপন করেছেন। তিনি বলেন, এবারে জুমক্ষেতের ফলন ভাল হয়েছে,কারণ চলতি মৌসুমের আবহাওয়া খুবই ভাল এবং উৎপাদন পরিবেশ ভালই ছিল। তাই বছর ২৫০ আড়ি ধান পাবে বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি। আরেক জন জুম চাষী রামরি পাড়া কারবারি মেনরুম ম্রো( ৫২ ) তিনি তিন আড়ি ধান রোপন করেছেন। তাঁর ধান কাটার শেষ। তিনিও ৬০ আড়ি ধান পেয়েছেন বলে জানান। তবে বর্তমানে মাটির উর্বরতা কমে যাওয়ার কারণে মাত্র তিন কানী অর্থাৎ তিন আড়ি জায়গার মধ্যে বস্তা সার প্রয়োগ করতে হয়েছে বলে জানান।

জেলার সাতটি উপজেলায় বিশেষ করে দুর্গম পাহাড় গুলোতে চলতি মৌসুমে রোপিত ধান পেকেছে। এসব কৃষিপণ্য জুম ক্ষেত থেকে আহরণ করে ক্ষেত-খামার এবং ঘরে তুলতে শুরু করেছেন জুমচাষিরা। ইতিমধ্যে চাষিরা জুম থেকে পাকা ধানসহ বিভিন্ন জাতের ফসল কাটতে শুরু করেছে। জেলা শহর থেকে ওয়াইজংশন এবং চিম্বুক এলাকায় পাহাড়ে পাহাড়ে দেখা গেছে পাকাধান কাটতে নারী-পুরুষ জুমচাষিদের। ধানের পাশাপাশি ছোটমরিচ, কচু, শিমুল আলু, বরবটি, ঢেঁড়স, চিংঙা, চিংচিংঙা,মারফা,মিষ্টি কুমরা,কুমড়া,তিল, হলুদ, আদার, ভুট্টা জুমের বিভিন্ন জাতের শাকসবজি চাষ হয়ে থাকে। তবে তিল,হলুদ আদা সংগ্রহ করা যাবে আরও কয়েক মাস পর। জেলার সদর, লামা, রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি, আলীকদম নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দুর্গম এলাকা পাহাড়গুলোতে একইভাবে জুমচাষ হয়েছে এবং ধান কাটা শুরু করেছে।

বান্দরবানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অতিরিক্ত উপ-পরিচালক তৌফিক আহমেদ নূর বলেন, পাহাড়ি বেশির ভাগ মানুষ জুম চাষ নির্ভর। আবাদী জমিতে ফলন কম হলে খাদ্য ঘাটতি দেখাই। প্রতিবছর জুম চাষ করে তাদের আর্থ সামাজিক উন্নয়নসহ আর্থিক স্বচ্ছলতা আসে এবং সারা বছরের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। বান্দরবানের চাকমা,মারমা, ত্রিপুরা,ম্রোসহ ১১টি জুমিয়া সম্প্রদায়ের আয়ের প্রধান উৎস জুমচাষ। তারা এক মৌসুমের জুমের উৎপাদিত ফসল দিয়ে সারা বছরের পরিবারের খাদ্য যোগান দেন। ওই সম্প্রদায়গুলো যুগযুগ ধরে এভাবে জীবন যাপন করে আসছেন।

বান্দরবান কৃষি বিভাগ তথ্য মতে, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে আবাদের লক্ষমাত্রা ছিল ৭হাজার ৪শত ৬০ হেক্টর। উৎপাদনের লক্ষমাত্রা ছিল ১০ হাজার ৭১ মেট্রিকটন। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের আবাদের অর্জন হয়েছে হাজার ২শত ৬৭ হেক্টর। উৎপাদনের অর্জন হয়েছে ১২ হাজার ৪শত ৯৯ মেট্রিকটন। যা গত বছরে তুলনায় এবার ৯৩ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ বাড়ছে বলে জানান অতিরিক্ত উপ-পরিচালক তৌফিক আহমেদ নূর।

বান্দরবানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অতিরিক্ত উপ-পরিচালক তৌফিক আহমেদ নূর বলেন,প্রতিটি পাহাড়ের এখন জুমের ধান কাটার শুরু হয়েছে। তাছাড়া এই পর্যন্ত আবহাওয়া মোটামুটি ভালো আছে ফলনও তেমন খারাপ হয় নাই। তাই চলতি বছরে জুমের ফলন মোটামুটি ভালো অর্জন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।



banner close
banner close