কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে সন্ধ্যা নামলেই শুরু হয় অন্য রকম ব্যস্ততা। ভ্রমণ শেষে যখন পর্যটকরা দল বেঁধে সৈকতের দিকে আসেন, তখন রাস্তার দু’ধারে, বালিয়াড়ি জুড়ে জ্বলতে থাকে চুলা। ধোঁয়ার কুণ্ডলী আর মসলার ঘ্রাণ আকৃষ্ট করে পর্যটকদের। ভ্যান বা অস্থায়ী দোকানে সাজানো থাকে টুনা, স্যালমন, রুপচাঁদা,চিংডি, কোরাল, রেড স্ন্যাপার, চিংড়ি,লইট্টা, কাঁকড়া, অক্টোপাস, স্কুইডসহ নানা সামুদ্রিক মাছ। অনেক পর্যটকের কাছে এ যেন কক্সবাজার ভ্রমণের বিশেষ আকর্ষণ।
ফিশ ফ্রাই বিক্রি করে কক্সবাজারের অনেকে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু মান নিয়ন্ত্রণের অভাবে পুরো খাতই বিতর্কিত হয়ে উঠেছে।
এই জনপ্রিয় ফিশ ফ্রাইয়ের আড়ালেই লুকিয়ে আছে বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, পঁচা মাছ আর বারবার ব্যবহার করা তেল মিলে পর্যটক ও স্থানীয়দের জন্য তৈরি হয় স্বাস্থ্যঝুঁকি।
সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে দেখা যায়, দোকানিরা ফ্রিজবিহীন অবস্থায় সামান্য বরফে সারাদিন মাছ রেখে দেন। কড়া রোদ আর সমুদ্রের আর্দ্রতায় দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়া এসব মাছের চোখ ফ্যাকাসে, গিলস কালচে হয়ে গেলেও পর্যটকের হাতে তুলে দেওয়া হয় অনায়াসেই।
অভিযোগ উঠেছে, বাইরে সাজানো টাটকা মাছ দেখিয়ে গ্রাহক টানলেও ভাজার সময় ব্যবহার করা হয় বাসি বা আগের দিনের মাছ। নেই কোনো নির্দিষ্ট মূল্য তালিকা। যখন যাকে যেভাবে পারে সেভাবেই আদায় করে টাকা। আশেপাশের পরিবেশও অপরিচ্ছন্ন।
স্থানীয় এক দোকানি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দিনে মাছ বিক্রি না হলে সেটা ফেলে দেওয়া হয় না বরং বরফ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। অনেক সময় দুই-তিন দিন পর্যন্তও এভাবে রাখা হয়।
শুধু মাছই নয়, ভাজার তেলের অবস্থাও সমান ভয়াবহ। একবার নয়, একই তেল টানা কয়েকদিন ব্যবহার করা হয়। ফলে তেল কালচে হয়ে যায়, গাঢ় ধোঁয়া ওঠে আর ছড়ায় দুর্গন্ধ। ব্যবসায়ীদের যুক্তি প্রতিদিন নতুন তেল ব্যবহার করলে খরচ বেড়ে যায়।
এই পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ঢাকার পর্যটক জাহিদ হাসান। তিনি বলেন, 'কক্সবাজারে এসে সামুদ্রিক মাছ না খেলে ভ্রমণটাই অসম্পূর্ণ মনে হয়। কিন্তু ফ্রাইয়ের পর খাওয়ার সময় গন্ধেই বোঝা যায় মাছটা টাটকা নয়। তেলের মানও খুব খারাপ। অথচ দাম রাখা হয় অস্বাভাবিকভাবে বেশি।'
চট্টগ্রাম থেকে আসা পর্যটক শারমিন ইয়াসমিনও একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন । তার অভিযোগ, 'বাইরে সাজানো টাটকা মাছ দেখে আমরা অর্ডার দিই। কিন্তু পরে রান্নার সময় অন্য মাছ দিয়ে প্রতারণা করে। একজন পর্যটক হিসেবে এর কোনো প্রতিকার আমাদের হাতে থাকে না। প্রশাসনের উচিত নিয়মিত অভিযান চালানো।'
চিকিৎসকদের মতে, পঁচা মাছ ও বাসি তেল খেলে ডায়রিয়া, ফুড পয়জনিং, হেপাটাইটিসসহ নানা জটিল রোগ হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে লিভারের ক্ষতি, এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়তে পারে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য এটি মারাত্মক প্রাণঘাতী হতে পারে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সম্প্রতি কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশ সৈকত এলাকায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে বেশ কয়েকটি দোকান থেকে পঁচা মাছ ও বারবার ব্যবহৃত তেল জব্দ করা হয় এবং ধ্বংস করা হয়। অসাধু ব্যবসায়ীদের কড়া সতর্কবার্তা দেওয়া হয় যেন ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ না করে।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার রিজিয়নের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, 'আমরা প্রতিনিয়তই অভিযান পরিচালনা করছি যেন পর্যটকদের সাথে অনিয়ম না হয় ও তাদের ঠকানো না যায়। যারা ফিস ফ্রাই বিক্রি করে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। দোকানে সাজিয়ে রাখা টাটকা মাছ পর্যটকরা ফ্রাইয়ের জন্য অর্ডার করলেও সুকৌশলে পঁচা-বাসি মাছ গছিয়ে দেন বিক্রেতারা। এছাড়া এসব দোকানের পরিবেশও চরম অস্বাস্থ্যকর। ফিসফ্রাই ব্যবসায়ীরা মাছ দেখায় একটা, কিন্তু রান্না করার সময় দেয় আরেকটা। এরকম করা চলবে না। বরং পর্যটকের সামনেই সব করতে হবে৷ এখানে বেশিরভাগ মাছ পঁচা এবং দীর্ঘদিন ধরে বরফ দিয়ে রাখা হয়। এ ধরনের পঁচা মাছ এবং পঁচা তেল দিয়ে কোন মাছ ব্যবসায়ীকে ব্যবসা করতে দেওয়া হবে না। আমার সামনেই তারা পঁচা মাছ ফেলে দিয়েছে। এই অভিযান আমাদের প্রতিনিয়ত চলতে থাকবে।'
জেলার নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা মোঃ নাজমুল ইসলাম বলেন, 'সৈকত এলাকায় অনেক দোকানই স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে ব্যবসা করেন । মাছ রাখার সঠিক ব্যবস্থা নেই, আবার ভাজার তেল বারবার ব্যবহার করা হয়—এসব একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। আমরা ইতোমধ্যে পরিস্থিতি চিহ্নিত করেছি এবং নিয়মিত মনিটরিং বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যৌথভাবে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করেছি। পর্যটকদের নিরাপদ খাবার নিশ্চিতে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না।
আরও পড়ুন:








