রবিবার

১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৩০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

পাহাড়িদের ভরসা জুম চাষ; ঐতিহ্য ও টিকে থাকার সংগ্রাম

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৭ আগস্ট, ২০২৫ ১২:৪৩

আপডেট: ২৭ আগস্ট, ২০২৫ ১২:৫৭

শেয়ার

পাহাড়িদের ভরসা জুম চাষ; ঐতিহ্য ও টিকে থাকার সংগ্রাম
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি জেলা বান্দরবান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর জেলায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে এক অনন্য কৃষিপদ্ধতি জুম চাষ। শত শত বছর ধরে পাহাড়ের মানুষ পদ্ধতিতেই ফসল ফলিয়ে আসছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া চাষাবাদ শুধু খাদ্যের জোগানই দেয় না, বরং এটি তাদের সংস্কৃতি, সামাজিক বন্ধন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

জুম চাষের প্রক্রিয়া ভিন্নরকম। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে শুকনো গাছপালা আগুনে পুড়িয়ে জমি প্রস্তুত করে। তারপর বৃষ্টির মৌসুমে পাহাড়ের ঢালে ধান, ভুট্টা, তিল, কুমড়া, মরিচ, ডাল নানা ধরনের সবজির বীজ ছিটিয়ে দেয়। একই জমিতে একসঙ্গে একাধিক ফসল ফলানোই জুম চাষের মূল বৈশিষ্ট্য। কয়েক মাস পর জমি থেকেই পরিবারগুলোর বছরের খাদ্য চাহিদা মেটে, আর অতিরিক্ত ফসল স্থানীয় হাটে বিক্রি করে নগদ আয় হয়।

জুম চাষের সঙ্গে পাহাড়িদের জীবনধারা একাকার হয়ে আছে। পরিবার-পরিজন মিলে দলে দলে জুমে যায়। কেউ গাছ কাটে, কেউ আগাছা পরিষ্কার করে, কেউ বা বীজ ছিটায়। কাজ শেষ হলে সবাই মিলে গান গেয়ে, ঢোল বাজিয়ে আবার বাড়ি ফিরে আসে। পাহাড়িদের কাছে এটি কেবল কৃষিকাজ নয়, বরং এক ধরনের সামাজিক উৎসব।

তবে জুম চাষ নিয়ে আছে ভিন্নমতও। পরিবেশবিদদের মতে, জুম চাষ বারবার জমি পোড়ানোর কারণে পাহাড়ের বনভূমি উজাড় হচ্ছে, মাটি ক্ষয় হচ্ছে এবং জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। বন ধ্বংস হওয়ায় বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সংকুচিত হচ্ছে এবং ভূমিধসের ঝুঁকিও বাড়ছে। ফলে কৃষিপদ্ধতিকে অনেকেই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর মনে করেন।

অন্যদিকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দাবি, জুম চাষ তাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। আধুনিক কৃষি পদ্ধতি পর্যাপ্ত জমি না থাকায় তারা এখনো প্রাচীন কৃষিপদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। বান্দরবানের রুমা উপজেলার ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের কয়েকজন কৃষক বলেন, “আমরা ছোটবেলা থেকে জুম চাষ করে আসছি। এতে একসঙ্গে ধান, ভুট্টা, মরিচ, কুমড়াসহ অনেক কিছু পাওয়া যায়। আমাদের পরিবার এই ফসলেই বেঁচে থাকে।

তবে পাহাড়িদের দাবি, সামান্য সরকারি সহায়তা আধুনিক প্রযুক্তি পেলে তারা জুম চাষকে আরও ফলপ্রসূ করতে পারবেন। জুম চাষে জড়িত অন্য কৃষক বলেন, “আমাদের পর্যাপ্ত সার, উন্নত বীজ কৃষি ঋণ দেওয়া হলে ফসলের উৎপাদন বাড়বে। তখন বাজারেও ভালো দামে বিক্রি করা সম্ভব হবে।

বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি কর্মকর্তা মো. রাশেদুল ইসলাম জানান, “জুম চাষ পাহাড়িদের ঐতিহ্যের অংশ। তবে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা তাদের ফলদ বাগান, সবজি চাষ আধুনিক কৃষি পদ্ধতিতে উদ্বুদ্ধ করছি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জুম চাষকে পুরোপুরি বন্ধ না করে এটিকে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বয় করা জরুরি। পাহাড়িদের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে তাদের ঐতিহ্যবাহী কৃষি সংস্কৃতিকে সম্মান জানিয়ে টেকসই সমাধান খুঁজতে হবে।

পাহাড়ের প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে জুম চাষ এখনও টিকে আছে। সীমাহীন কষ্ট, আধুনিকতার চ্যালেঞ্জ পরিবেশগত সমালোচনা সত্ত্বেও এটি আজও পাহাড়িদের জীবনের প্রধান ভরসা। যতদিন না উপযুক্ত বিকল্প তৈরি হয়, ততদিন বান্দরবানের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবন সংস্কৃতির সঙ্গে সমানতালে চলতে থাকবে এই ঐতিহ্যবাহী জুম চাষ।



banner close
banner close