শনিবার

২০ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৫ পৌষ, ১৪৩২

বালিয়াডাঙ্গীর মেহমানখানা: যেখানে ভিক্ষুকও পান অতিথির মর্যাদা

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি:

প্রকাশিত: ১ আগস্ট, ২০২৫ ২০:৪৬

শেয়ার

বালিয়াডাঙ্গীর মেহমানখানা: যেখানে ভিক্ষুকও পান অতিথির মর্যাদা
ছবি সংগৃহীত

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের ভয়াবহতার সময় একদিকে মানুষের স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ে, অন্যদিকে অসহায় মানুষের অনাহার ও আর্তনাদ বাতাসে মিশে গিয়েছিল। সেই সময় ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ফুলতলা গ্রামের হারুন অর রশিদ একটি ব্যতিক্রমী মানবিক উদ্যোগ নেন—‘মেহমানখানা’ প্রতিষ্ঠার। উদ্দেশ্য ছিল, অসহায় ভিক্ষুক ও দুস্থ মানুষের মুখে অন্তত একবেলা খাবার তুলে দেওয়া।

২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে এই উদ্যোগ। প্রথম দিন ৫০-৬০ জন মানুষকে খাওয়ানোর মাধ্যমে যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে প্রতি শুক্রবার ১৫০ থেকে ২০০ জন অসহায় মানুষ এখানে আহার গ্রহণ করেন। ২৯ মে ‘মেহমানখানা’র ১৯৭তম সাপ্তাহিক আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রায় ২৫০ জনকে খাবার পরিবেশন করা হয়।

শুরুর পেছনের গল্প

হারুন অর রশিদ বলেন, “করোনার সময় একদিন দুপুরে এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক এসে বললেন, ‘তিন-চারটি বাড়িতে গেছি, কেউ ভাত তো দূরের কথা, দরজাটাও খোলেনি।’ এই কথা শুনে আমি গভীরভাবে ব্যথিত হই এবং তখনই সিদ্ধান্ত নিই, এমন মানুষদের জন্য কিছু করতে হবে।”

প্রথমে এর নাম ছিল ‘হতভাগা সেন্টার’। পরে ফেসবুক বন্ধুদের পরামর্শে নামকরণ করা হয় ‘বালিয়াডাঙ্গী মেহমানখানা’।

সম্মানের সঙ্গে আহার

‘মেহমানখানা’ শুধু একটি খাবারের স্থান নয়, এটি একটি সম্মানের জায়গা। এখানে দুস্থদের অতিথির মর্যাদা দিয়ে চেয়ারে বসিয়ে পরিবেশনের মাধ্যমে খাবার দেওয়া হয়। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের পর শুরু হয় খাবার বিতরণ। খাবারের মেনুতে থাকে ভাত, ডাল, সবজি এবং কখনও মাছ, ডিম, মুরগি বা গরুর মাংস।

রান্নার দায়িত্বে থাকা জিয়াখোর গ্রামের বাবুর্চি মনসুর আলী বলেন, “মেহমানখানায় রান্নার কাজ করে যে তৃপ্তি পাই, তা কোনো পারিশ্রমিকের চেয়ে বড়।”

একার নয়, একতার শক্তিতে

প্রথম তিন সপ্তাহ হারুন নিজে খরচ চালালেও পরে ২৫ জনের বেশি সহযোগী যুক্ত হন। কেউ দিয়েছেন অর্থ, কেউ থালা-বাসন কিংবা চেয়ারের মতো উপকরণ। স্বচ্ছতা বজায় রাখতে প্রতিটি ব্যয়ের বিবরণ ফেসবুকে প্রকাশ করা হয়।

আবুল কালাম আজাদ বলেন, “এটি ব্যতিক্রমী ও মানবিক একটি উদ্যোগ। এমন কার্যক্রম বিস্তৃত হলে এলাকার অসহায় মানুষের কষ্ট অনেকটা লাঘব হবে।”

মেহমানখানার অন্যতম সংগঠক আবু শাহীন জানান, “আমরা কাউকে আমন্ত্রণ জানাই না কিংবা নির্দিষ্ট কারও কাছে কিছু চাই না। কেউ স্বেচ্ছায় যা দেন, তা-ই গ্রহণ করি।”

মানবিকতার প্রতীক

গৃহবধূ জরিনা বলেন, “এখানে খেতে এসে খারাপ লাগে না, সবাই অনেক ভালো ব্যবহার করে।” মহাসিন আলীও একই কথা বলেন, “এখানে আসলেই মনে হয় আমরা মেহমান।”

সামাজিক স্বীকৃতি ও প্রশাসনের সহযোগিতা

বালিয়াডাঙ্গী লাহিড়ী বড় মসজিদের ইমাম মুফতি নুর হোসাইন বলেন, “দুস্থদের একমুঠো খাবার দেওয়ার মতো মহৎ কাজ খুব কমই হয়। আল্লাহ যেন এই আয়োজন দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখেন।”

স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী আল মামুন জীবন বলেন, “চার বছর পেরিয়ে অনেক গ্লাস, প্লেট ও চেয়ার নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু মানবিক মানুষ এগিয়ে এলে খাবারের মান আরও উন্নত করা সম্ভব।”

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পলাশ কুমার দেবনাথ বলেন, “হারুন অর রশিদের এই মহৎ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।”

মানবতা অব্যাহত থাকুক

মেহমানখানা প্রতিবার আয়োজন করতে ১০-১৫ হাজার টাকা খরচ হয়, যা আসে হারুন ও তাঁর সহযোগীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়া হয়েছে।

“যখন একটি উদ্যোগ সর্বজনীন হয়ে যায়, তখন সেটা থেমে যাওয়ার ভয় থাকে না, নিজের কর্মপ্রচেষ্টা সম্পর্কে এমন আত্মবিশ্বাসী উচ্চারণ করেন হারুন অর রশিদ।



banner close
banner close