গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের চতুর্থ বংশধর (নাতনী) প্রতিমা মজুমদার। গৃহহীন-ভূমিহীন অসহায় দরিদ্র প্রতিমা মজুমদার একমাত্র মেয়েকে নিয়ে পরিত্যক্ত ছোট্ট একটা খুপড়ি ঘরে বসবাস করে। অর্থের অভাবে চরম দুঃখ দুর্দশা আর দুর্ভোগের মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। তাদের দিন কাটে অনাহারে-অর্ধাহারে।
বৃদ্ধা প্রতিমা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেন না৷ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শৌচাগার, টিউবওয়েল সহ মৌলিক চাহিদার অভাবে সীমাহীন কষ্ট করছেন তারা। কেউ তাদের খোঁজ নেন না, কেউ সাহায্য-সহযোগিতা করেন না। কাঙ্গালের সর্বশেষ বংশধর হয়েও সকল অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং চরমভাবে বৈষম্যের শিকার প্রতিমা মজুমদার৷ আজ (রোববার, ২০ জুলাই) কাঙ্গাল হরিনাথের ১৯২ তম জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানেও দাওয়াত পায়নি তিনি। আগেও কখনো কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পান নি।
দুঃখ প্রকাশ করে কাঙ্গাল হরিনাথের চতুর্থ বংশধর প্রতিমা মজুমদার (৫৪) বলেন, কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার আমার বড় বাবা হয়। চতুর্থ বংশধরের মধ্যে শুধুমাত্র আমিই এখানে বসবাস করি। আমি কাঙ্গাল হরিনাথের পৈণনাতনী। আমি অনেক নির্যাতিত ও সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আমি অনেক জায়গায় অনেক দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু সরকার মঞ্জুর করেনি। অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছি, অনেক দরখাস্ত করেছি। আমার অর্থ ও সময় খরচ হলো, কষ্ট হলো। কিন্তু কিছুই হয়নি। এখন জীবনের শেষ মুহুর্তে আর আমাদের কোনো দাবি নেই। সরকারের কাছে অনেক দাবি করেছি, কোনো লাভ হয়নি।
কাঁদতে কাঁদতে প্রতিমা মজুমদার আরও বলেন, আমি চতুর্থ বংশধর আর যারা সুযোগসুবিধা ভোগ করছে তারা পঞ্চম বংশধর। আমার ভাইয়ের ছেলে দেবাশীষ ও দীপংকর সকল সুযোগসুবিধা পায়। তাদের পরিবারের দুজন জাদুঘরে চাকরি করে, তারা অনেক লাখ টাকাও পেয়েছে। সবকিছু থেকে আমরা বঞ্চিত। পারিবারিকভাবেও সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত ও নির্যাতিত। তারা আমাদের পরিচয়ই দেয় না। মনের কষ্টে জাদুঘরের ওদিকে তাকাই না। আজ পর্যন্ত আমি জাদুঘরে যায়নি। কখনো কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত পায় না। এবারও দাওয়াত পাইনি৷ এতো এতো সুযোগসুবিধা তারা পাচ্ছে আর আমরা টাকার অভাবে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছি। টাকার অভাবে পরিত্যক্ত জায়গায় বাস করি। চিকিৎসা করাতে পারি না। কোনো প্রয়োজন মিটানোর সামর্থ্য নেই আমাদের৷ কেউ কোনো খোঁজ নেয় না, সাহায্য সহযোগিতাও করে না।
প্রতিমা মজুমদার আরও বলেন, কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার আমার বড় বাবা হয়। কাঙ্গাল হরিনাথের চার পুত্র ছিল। তারা হলেন সতীশ, বানিশ, বিজয় ও বসন্ত। উনার মেয়ে সন্তান ছিল না। মেজ ছেলে বানিশ চন্দ্রের বংশধর আমরা। বাকিরা সব ভারতে চলে গেছে। বানিশ চন্দ্র মজুমদারের ছেলে অতুল কৃষ্ণ। তার ৬টা সন্তান (মিলা, লক্ষী, স্বরস্বতী, অশোক, প্রতুল আর আমি প্রতিমা মজুমদার)। বর্তমানে সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আমার ভাই অশোখের ছেলে দেবাশীষ ও তার পরিবার। আর আমি আগের বংশধর হয়েও বঞ্চিত। আমার মা সবকিছু থেকে বঞ্চিত ছিল। তারা আমার মাকেও নির্যাতন করেছে। জায়গা দেয়নি, ভাত দেয়নি। আমাকেও কেউ ভাত দেয় না। কাঙ্গালের দুইটা বাড়ি আমার মায়ের নামে ছিল। সবকিছু আত্মসাত করা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কুণ্ডুপাড়ায় কাঙ্গালের বাস্তভিটা ও স্মৃতি জাদুঘরের পাশে পরিত্যক্ত ও বসবাসের অযোগ্য ছোট্ট একটা খুপরি ঘরে বসবাস করে প্রতিমা মজুমদার ও তার মেয়ে আনন্দময়ী কান্তা। প্রতিমা মজুমদার অসুস্থ হয়ে রোগ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। তার অনাহারী মেয়ে তার পাশে বসে সেবা করছেন। অর্থের অভাবে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেনি। অর্থের অভাবে প্রায় দিনই অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটে। ঠিকমতো কাপড়চোপড়ও কিনতে পারে না। অন্যের দেয়া পুরাতন কাপড়চোপড় পরে তারা। সেখানে নেই যাতায়াতের রাস্তা। নেই রান্নাঘর, টিউবওয়েল ও বাথরুম। অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটে তাদের। অর্থের অভাবে কখনও কখনও না খেয়েও দিন পার করতে হয় তাদের। চরম দুঃখ দুর্দশা আর দুর্ভোগের মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এই মা-মেয়ে। রোদ, শীত, বৃষ্টিতে ১২ মাসই তাদের কষ্ট। বসবাসের অযোগ্য একটা পরিত্যক্ত ঘরে তারা কোনোভাবে জীবনযাপন করে।
কাঙ্গাল হরিনাথের চতুর্থ বংশধর প্রতিমা মজুমদারের মেয়ে আনন্দময়ী কান্তা বলেন, আমি ও আমার মা কাঙালের বংশধর। আমরা সবকিছু থেকে বঞ্চিত। আমাদের কেউ কোনো দাম দেন না। জাদুঘরে কাগজপত্র জমা দিয়েছি৷ কিন্তু চাকরি দিইনি। আমাদের বঞ্চিত না করে ঝাড়ুদারের চাকরি তো দিতে পারতো। তাও দেইনি। আমার বড় মামার ছেলে দেবাশীষ ও দীপংকর মজুমদার দাদা এবং আমার বড় মামী গীতা মজুমদার আমাদের সকল সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। নানা ষড়যন্ত্র করে তারা৷ ওরা আমাদের পরিচয় দিতে চায় না। আমরা মেয়ে বলে তারা কোনো অধিকার দেয় না। ওরা বলে, তোরা মেয়ে, তোদের কোনো অধিকার নেই। কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার আমার মার বড় বাবা। কাঙ্গাল আমার বড় দাদু হয়। আমার বড় মামা মারা গেছে। তার দুই ছেলে আমাদের পরিচয়ও দেন না।
স্থানীয়রা বলেন, কাঙ্গালের বংশধরদের বেশ কয়েকটি পরিবার এখানে বসবাস করে। তাদের মধ্যে অশোক মজুমদারের ছোট ছেলে দেবাশীষ মজুমদার, তার মা, বড় ভাই সরকার থেকে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ও টাকা পয়সা পায়। দেবাশীষ মজুমদার ও তার স্ত্রী পবিত্রা রানী জাদুঘরে চাকরি পেয়েছে৷ সরকার থেকে ২০ লাখ টাকা পেয়েছেন। সবাইকে বঞ্চিত করে গায়ের জোরে এসব করে দেবাশীষ। দেবাশীষ ঠিক মতো দায়িত্ব পালন করে না। অন্য পরিবার গুলো সমস্ত সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অন্যান্য পরিবারের কেউ চাকরি পায়নি। তারা টাকা ও সম্মান কিছুই পায় না।
তারা আরও বলেন, চতুর্থ বংশধর প্রতিমা মজুমদার ও পঞ্চম বংশধর রতন সহ অন্যান্যদের জন্মবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী সহ অনুষ্ঠান গুলোতেও তাদের দাওয়াত দেয়া হয় না। তার কোনো ধরনের সুযোগ সুবিধা ও সম্মান পান না। সবক্ষেত্রেই তারা বঞ্চিত। প্রতিমা মজুমদার অসুস্থ। টারা অভাবে চিকিৎসা করাতে পারে না। পরিত্যক্ত বসবাসের অযোগ্য ঘরে বসবাস করে। অনাহারে অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন করে। তার কষ্ট কেউ দেখে না। সরকার কোনো সহযোগিতাও করে না। এই বৈষম্য দূর করা হোক। সবাইকে সমান সুযোগ সুবিধা দেয়া হোক। সমস্ত সমস্যা সমাধান ও প্রতিমাকে সাহায্য সহযোগিতার দাবি জানিয়েছেন তারা।
কাঙ্গাল হরিনাথের পঞ্চম বংশধর রতন মজুমদার। তারা তিন ভাই। তাদের বাবার নাম রাম মজুমদার। রতন মজুমদার বলেন, কাঙ্গাল হরিনাথের সবকিছু থেকে আমরা বঞ্চিত। এখানে ২০ লক্ষ টাকা এসেছে, ২০ লক্ষ টাকার এক টাকাও আমরা পাই নি। তারাই দুইভাই পাইছে। দীপংকর ও দেবাশীষ সমস্ত তত্ত্বাবধান করে। জাদুঘরে দেবাশীষ ও তার স্ত্রী পবিত্রা রানী অফিস সহকারীর চাকরি করে। আমাদের কারো চাকরি হয়নি। অনুষ্ঠান গুলোতেও আমদের দাওয়াত দেয়া হয় না। আমাদের এমনভাবে বঞ্চিত ও উৎখাত করা হয়েছে যে, আমাদের নামটা পর্যন্ত ভালোভাবে নেই। শত্রুতা ও কারসাজি করে এমনটা করা হয়েছে৷ এছাড়াও দেবাশীষরা আমাদের পরিচয় দিতে চায় না। তারা বলে যে, আমরা কাঙ্গালের শরিখই না। দেবাশীষের বাবা অশোক মজুমদারের বোন প্রতিমা মজুমদার বেঁচে আছে। উনি চতুর্থ বংশধর। উনিও সবকিছু থেকে বঞ্চিত। একমাত্র মেয়ে সন্তানকে নিয়ে অনেক কষ্টে মানবেতর জীবনযাপন করে। পরিত্যক্ত ঘরে বসবাস করে৷ অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারে না। অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটে তাদের। তারাও সবকিছু থেকে বঞ্চিত।
তিনি আরও বলেন, ওরাই গায়ের জোরে ভোগদখল করতেছে। আমাদের অনেক অধিকার আছে। অধিকার আদায় করতে হলে অনেককিছু করতে হবে। অধিকার আদায়ের জন্য কে ঝামেলা মারামারি করতে যাবে? যেভাবে আছি, এভাবেই থাকি৷ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, আমার বাবার নাম রাম মজুমদার। তার বাবার নাম কালিপদ মজুমদার, তার বাবা সুরেশ মজুমদার, তার বাবা রাজ কিশোর মজুমদার। আমি এই পর্যন্তই জানি।
সকল অভিযোগ অস্বীকার করে দেবাশীষ মজুমদার বলেন, কাঙ্গাল হরিনাথের পঞ্চম বংশধর হিসেবে আমি ও আমার স্ত্রী জাদুঘরে চাকরি করি। কে চাকরি পাবে আর কে পাবে না, সেটা অফিসের ব্যাপার। প্রতিমা মজুমদার চতুর্থ বংশধরের বোন। বংশধর ছেলেরা হয়, মেয়েরা হয় না। সে পরঘরে হয়ে গেছে। বিয়ের পরে স্বামীর ঘরই সব। প্রতিমা আমার ফুফু। বাবা মরার পরে সব বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সে এখন আমাদের কেউ না। তাকে কেন সহযোগিতা করবো। আমি কাউকে বঞ্চিত করিনি। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দেয়া হয়েছে।
কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘরের রেপ্লিক ম্যানুফেকচারার ও ইনচার্জ তাপস কুমার মন্ডল বলেন, জাদুঘরে পঞ্চম বংশধর দেবাশীষ ও তার স্ত্রী চাকরি করে। অনুষ্ঠানে দেবাশীষের মা গীতা রানী মজুমদারকে বিশেষ অতিথি করা হয়েছে। আমি এখানে অল্প সময় এসেছি। এখনো সবকিছু জানি না। বেশকিছু সমস্যা আছে। দেবাশীষের পরিবারের বাইরের বংশধরদের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখবো এবং আগামীতে আমন্ত্রণ জানাবো৷
এবিষয়ে কথা বলার জন্য কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. তৌফিকুর রহমানের মুঠোফোনে কল করলেও তিনি রিসিভ করেন নি।
প্রসঙ্গত, ১৮৩৩ সালের ২২ জুলাই কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কুণ্ডুপাড়ায় (ব্রিটিশ ভারতের নদীয়া জেলা) হতদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করা হরিনাথ মজুমদার অর্থের অভাবে বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারেননি। তবে ছোটবেলা থেকেই খুব প্রতিবাদী ও অসাধারণ প্রতিভাবান ছিলেন। অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, নিপীড়নের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। মানবিকতা ও বিবেকের তাড়নায় অত্যাচারিত, অসহায়, নিষ্পেষিত মানুষকে রক্ষার জন্য সাংবাদিকতা পেশাকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন হরিনাথ মজুমদার। তার বাবার নাম হলধর মজুমদার ও মায়ের নাম কমলিনী দেবী।
ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৬৩ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সে 'গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ নামের পত্রিকা সম্পাদনা করেন কাঙ্গাল হরিনাথ। সামাজিক সমস্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ, অত্যাচার, দুর্নীতির সহ অত্যাচারী ইংরেজ জমিদার, সরকারি কর্মকর্তা, নীলকর সাহেব, মহাজনদের অপকর্মের সংবাদ প্রকাশিত করতেন। গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙাল হরিনাথ মজুমদার আমৃত্যু প্রতিবাদী ছিলেন। এজন্য তাকে নানান প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। সবকিছু মুকাবিলা করে অসহায় নির্যাতিত অবহেলিত মানুষের বিপদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটে যেতেন। ক্ষুরধার লিখনির মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতেন। তিনি একাধারে সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও বাউল গান রচয়িতা, সমাজসংস্কারক, প্রজাদরদি ও নারী জাগরণের অন্যতম দিকপাল ছিলেন। হরিনাথ মজুমদার ১৮৯৬ সালের ১৬ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তার নিজ বাড়ির একটি কক্ষের মধ্যেই তাকে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর প্রায় ২০০ বছর পরও শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় মানুষের মনে জাগ্রত হয়ে আছেন।
কাঙ্গালের হরিনাথ ফকির লালনের ভাবশিষ্য ছিলেন। কাঙ্গাল প্রায় ১ হাজার বাউল গান ও ৩৭টি বই লিখেছেন। ‘বিজয় বসন্ত’ তার লেখা প্রথম উপন্যাস। হরিনাথ মজুমদারের অনুপ্রেরণা ও সহায়তায় বিষাদ সিন্ধুর রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন, জলধর সেন, চন্দ্র শেখর কর সহ অনেকের মধ্যে সাহিত্যনুরাগ সঞ্চারিত হয়েছিল।
আরও পড়ুন:








