শনিবার

২০ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৫ পৌষ, ১৪৩২

অযত্ন অবহেলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে কাঙ্গালের স্মৃতি চিহ্ন

জেলা প্রতিনিধি, কুষ্টিয়া:

প্রকাশিত: ৩১ জুলাই, ২০২৫ ১৩:৪০

আপডেট: ৩১ জুলাই, ২০২৫ ১৪:০৬

শেয়ার

অযত্ন অবহেলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে কাঙ্গালের স্মৃতি চিহ্ন
ছবি বাংলা এডিশন

অযত্নে অবহেলায় গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের অনেক স্মৃতি চিহ্ন হারিয়ে যাচ্ছে। তার বাস্তভিটা ও কাঙ্গাল কুঠিরের ছাপাখানা সংস্কার, সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঘরগুলোর দেয়াল নষ্ট হয়ে খসে পড়ছে। জানালা-দরজা নষ্ট হয়ে গেছে। এভাবে অবহেলায় পড়ে থাকলে তার অনেক স্মৃতি চিহ্ন বিলীন হয়ে যাবে। এছাড়াও তার অনেক স্মৃতি চিহ্ন বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে রয়ে গেছে।

এদিকে কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘরে জনবল সংকট ও অব্যবস্থাপনা রয়েছে। প্রচার-প্রচারণার অভাবে দর্শনার্থীদের উপস্থিতি কম হয়। স্মৃতি চিহ্ন ও বাস্তভিটা সংরক্ষণ সহ সমস্যা গুলো দ্রুত সমাধানের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

স্থানীয়রা বলেন, যেই মহান মানুষটি অবহেলিত-নির্যাতিত ও দুখী মানুষের কাছে ছুটে যেতেন। লিখনীর মাধ্যমে তাদের সমস্যা সমাধান করতেন। আজ সেই মানুষটিই অনেক অবহেলিত। যে মানুষটি বৈষম্যহীন জনপদ গড়তে কাজ করেছিলেন। আজ সেই মানুষটি বৈষম্যের শিকার, তার বংশধররাও বৈষম্যের শিকার ও অবহেলিত। এসব নিয়ে কারো ভাবার সময় নেই। তার বাস্তভিটা ও ছাপাখানা অযত্নে অবহেলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও তার বহু স্মৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন মানুষের কাছে রয়েছে। সেগুলো সংগ্রহ সহ এসব সমস্যা সমাধান হওয়া খুবই জরুরি। তার স্মৃতি চিহ্ন গুলো সংরক্ষণ করা জরুরি। তাছাড়া এভাবে অবহেলায় পড়ে থাকলে তার স্মৃতি চিহ্ন বিলীন হয়ে যাবে।

তারা আরও বলেন, কাঙালের বংশধরদের বেশ কয়েকটি পরিবার এখানে বসবাস করে। তাদের মধ্যে অশোক মজুমদারের ছোট ছেলে দেবাশীষ মজুমদার ও তার পরিবার সরকার থেকে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ও টাকা পয়সা পায়। দেবাশীষ মজুমদার ও তার স্ত্রী পবিত্রা রানী জাদুঘরে চাকরি পেয়েছে৷ ২০ লাখ টাকা পেয়েছেন। গায়ের জোরে এসব করে দেবাশীষ। দেবাশীষ ঠিক মতো দায়িত্ব পালন করে না। অন্য পরিবার গুলো সমস্ত সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অন্যান্য পরিবারের কেউ চাকরি পায়নি। তারা টাকা ও সম্মান কিছুই পায় না। অনুষ্ঠান গুলোতেও তাদের দাওয়াত দেয়া হয় না। এই বৈষম্য দূর করা হোক। সবাইকে সমান সুযোগ সুবিধা দেয়া হোক। সমস্ত সমস্যা সমাধানের দাবি জানিয়েছেন তারা।

কাঙ্গালের বাস্তভিটায় গিয়ে দেখা যায়, ইতিহাস ঐতিহ্যের নিদর্শন পূর্ব বাংলার প্রথম ছাপাখানাটি অযত্নে অবহেলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ঘরের দেয়াল নষ্ট হয়ে খসে পড়েছে। জানালা-দরজা, মেঝে ও টিনের ছাউনি নষ্ট হয়ে গেছে। পরিত্যক্ত ছাপাখানা ও তার বসতবাড়িটির জরাজীর্ণ অবস্থা। চারপাশে বিভিন্ন গাছপালার ঝোপ, ময়লা আবর্জনা স্তূপ। সংস্কার, সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রাচীন বাংলার প্রথম ছাপাখানা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। যে ঘরে পদচারণা ছিল ফকির লালন শাহ, মীর মোশাররফ হোসেনের মতো সাহিত্যিকদের। কাঙ্গাল যেখানে বসে ১ হাজার বাউল গান ও ৩৭টি বই লিখেছেন, যেখান থেকে হরিনাথ মজুমদারের অনুপ্রেরণা ও সহায়তায় বিষাদ সিন্ধুর রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন, জলধর সেন, চন্দ্র শেখর করসহ অনেকের মধ্যে সাহিত্যনুরাগ সঞ্চারিত হয়েছিল। কাঙ্গালের সেই স্মৃতিচিহৃ আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।

কুমারখালীর সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার জাদুঘরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয়রা জানান, কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের চতুর্থ বংশধর অশোক মজুমদারের স্ত্রী গীতারানী মজুমদার ও দুই ছেলে দেবাশীষ মজুদার এবং দীপংকর মজুমদারের কারণে বাস্তুভিটার এই বেহাল অবস্থা। কাঙ্গাল হরিনাথকে নিয়ে তারা ব্যবসা শুরু করেছেন। এই পরিবারটি কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের কোন মূল্যায়ন করেননি। একদিকে সরকারকে অনেককিছু করতে দেয়নি, অন্যদিকে নিজেরাই কাঙ্গাল কুটিরকে আবর্জনার স্তুপ বানিয়ে রেখেছেন। বাস্তভিটা সংরক্ষণ, সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের দাবি জানিয়েছেন তারা।

সবশেষ ২০০৯ সালে বাস্তভিটায় নির্মিত হয় কাঙ্গাল হরিনাথ জাদুঘর ও পাঠাগার ভবন। এ পর্যন্তই শেষ। তারপর আর কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি বাস্তভিটায়। তারপরের গল্প ক্ষয়ে পড়া ও ধ্বংস হবার।

তবে সরকারি ২৮ শতক জমির ওপর ২০১৭ সালে প্রায় ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে কাঙ্গালের বাস্তভিটার পাশেই কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর করা স্থাপিত করা হয়। ২০১৭ সালে ৯ ডিসেম্বর জাদুঘরটির পথচলা শুরু হয়। পঞ্চম বংশধরের ওই পরিবারের সাথে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। সেই চুক্তি মতে চতুর্থ বংশধর অশোক মজুমদারের ছেলে ও ছেলের বউকে চাকরি এবং নগদ ২০ লক্ষ টাকা দিতে হবে। চুক্তি অনুযায়ী দুইজনকে চাকরি ও নগদ টাকা নিয়ে প্রেসের মেশিনসহ যন্ত্রাংশ জাদুঘরের কাছে হস্তান্তর করেন ওই পরিবার। জাদুঘরের গ্যালারিতে প্রায় ১৬৮টি স্মৃতি নিদর্শন রয়েছে। তারমধ্যে ঐতিহাসিক মুদ্রণযন্ত্র, হরিনাথের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র, পাণ্ডুলিপি, প্রেসের যন্ত্রাংশ, কবিতা, পত্রপত্রিকার প্রচ্ছদ, অক্ষর, ছবি, কাঠের ব্লক, পাথর সহ বিভিন্ন জিনিসপত্র সংরক্ষণ করা হয়েছে।

কাঙ্গাল হরিনাথ প্রেসক্লাবের সভাপতি কে এম আর শাহিন বলেন, কাঙ্গাল হরিনাথের গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকা ভারত উপমহাদেশের প্রথম বাংলা পত্রিকা। খুবই অত্যাধুনিক একটা প্রেস মেশিনে পত্রিকাগুলো ছাপা হতো। সে মেশিনটি বাস্তভিটা থেকে জাদুঘরে আনা হয়েছে একটি চুক্তির মাধ্যমে। পঞ্চম বংশধরের দুজনের চাকরি এবং ২০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে মেশিনটি জাদুঘরের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে দেবাশীষ মজুমদার বলেন, পুরাতন ছাপাখানা ও বাস্তুভিটা যতদিন যাচ্ছে তত নষ্ট হচ্ছে। যতদিন যাবে তত নষ্ট হবে। আমাদের কি করার আছে। আমাদের কোনো দাবি নেই, আমাদের বলারও কোনোকিছু নেই। সরকারকে সেখানে জাদুঘর করতে বা সংরক্ষণ করতে কখনো বাধা দিই নি। আমাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মিথ্যা।

কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘরের রেপ্লিক ম্যানুফেকচারার ও ইনচার্জ তাপস কুমার মন্ডল বলেন,

আমাদের এখানে সমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরি আছে৷ সেখানে ৭০০ বই আছে৷ কিন্তু একজন লাইব্রেরিয়ানের অভাবে সেটা চালু করতে পারি না। বইপ্রেমী গবেষক, সাহিত্যিক সহ সাধারন মানুষ এটা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, কাঙ্গাল হরিনাথের অনেক নিদর্শন স্থানীয় কিছু ব্যক্তিবর্গের কাছে সংরক্ষিত আছে৷ এগুলো সংগ্রহ করতে পারলে আমাদের যাদুঘরের গ্যালারিটা আরও সমৃদ্ধ হতো। আপনাদের সহযোগিতায় সেগুলো পেলে খুব ভালো হয়। আপনারা সহযোগিতা করবেন। দর্শনার্থীদের আনাগোনা বাড়াতে প্রচার-প্রচারণা দরকার। আমরা ৯জন কর্মকর্তা কর্মচারী কর্মরত আছি। এতো বড় জাদুঘর ৯ জন দিয়ে চালানো ট্রাফ হয়ে যায়। আরও কয়েকজন কর্মচারী যুক্ত করা হলে ভালোভাবে পরিচালনা করা সম্ভব। ছুটির দিনগুলোতে দর্শনার্থীদের উপস্থিতি বেশি দেখা যায়। সাধারণত প্রতিদিন ২০ জনের মতো দর্শনার্থী আসে এখানে।

১৮৩৩ সালের ২২ জুলাই কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কুণ্ডুপাড়ায় (ব্রিটিশ ভারতের নদীয়া জেলা) হতদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করা হরিনাথ মজুমদার অর্থের অভাবে বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারেননি। তবে ছোটবেলা থেকেই খুব প্রতিবাদী ও অসাধারণ প্রতিভাবান ছিলেন। অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, নিপীড়নের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। মানবিকতা ও বিবেকের তাড়নায় অত্যাচারিত, অসহায়, নিষ্পেষিত মানুষকে রক্ষার জন্য সাংবাদিকতা পেশাকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন হরিনাথ মজুমদার। তার বাবার নাম হলধর মজুমদার ও মায়ের নাম কমলিনী দেবী।

ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৬৩ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সে 'গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ নামের পত্রিকা সম্পাদনা করেন কাঙ্গাল হরিনাথ। সামাজিক সমস্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ, অত্যাচার, দুর্নীতির সহ অত্যাচারী ইংরেজ জমিদার, সরকারি কর্মকর্তা, নীলকর সাহেব, মহাজনদের অপকর্মের সংবাদ প্রকাশিত করতেন। গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙাল হরিনাথ মজুমদার আমৃত্যু প্রতিবাদী ছিলেন। এজন্য তাকে নানান প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। সবকিছু মুকাবিলা করে অসহায় নির্যাতিত অবহেলিত মানুষের বিপদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটে যেতেন। ক্ষুরধার লিখনির মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতেন তিনি।

প্রথম দিকে তিনি কবি ঈশ্বরচন্দ্রের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় স্থানীয় মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, অত্যাচার, অপরাধ নিয়ে প্রবন্ধ লিখতেন। পরে নিজ উদ্যোগে ১৮৬৩ সালে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করে৷ কলকাতার গিরীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন যন্ত্রে প্রথম মুদ্রিত হয়। এরপর ১৮৭৩ সালে নিজ বাড়িতে পত্রিকাটির নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮ বছর পর আর্থিক সংকট, আইনী জটিলতা সহ বিভিন্ন কারণে বন্ধ হয়ে যায় ছাপাখানাটি৷ এ মুদ্রণযন্ত্রটি ১৮৬৭ সালে লন্ডনের ১০ ফিন্সবারি স্ট্রিটের ক্লাইমার ডিক্সন অ্যান্ড কোম্পানি তৈরি করে। ১৯৯৪ সালে সর্বশেষ এই যন্ত্রে কিছু ছাপা হয়েছিল। তারপর আর কোনোকিছু ছাপা হয়নি বলে জানা গেছে। মুদ্রণযন্ত্রটি জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

ব্রিটিশ শাসনামলে যেসময় হতদরিদ্র ও কৃষকদের ওপর ইংরেজরা ও জমিদাররা অত্যাচার করতো। সেই দুঃসময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়িয়ে সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে সমাধান করেছেন। তিনি একাধারে সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও বাউল গান রচয়িতা, সমাজসংস্কারক, প্রজাদরদি ও নারী জাগরণের অন্যতম দিকপাল ছিলেন। হরিনাথ মজুমদার ১৮৯৬ সালের ১৬ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তার নিজ বাড়ির একটি কক্ষের মধ্যেই তাকে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর প্রায় ২০০ বছর পরও শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় মানুষের মনে জাগ্রত হয়ে আছেন।



banner close
banner close