শনিবার

২০ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৫ পৌষ, ১৪৩২

ইতালি যাওয়ার ফাঁদে কোটি টাকার প্রতারণা, লিবিয়ায় বন্দি মাদারীপুরের যুবকরা

মাদারীপুর প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২৮ জুলাই, ২০২৫ ১৪:৫৮

শেয়ার

ইতালি যাওয়ার ফাঁদে কোটি টাকার প্রতারণা, লিবিয়ায় বন্দি মাদারীপুরের যুবকরা
ছবি সংগৃহীত

উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে, ‘মাত্র তিন ঘণ্টায় পানি পথে ইতালি পৌঁছে দেওয়ার’ লোভনীয় প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন মাদারীপুরের একাধিক তরুণ। কিন্তু বাস্তবে সেই স্বপ্ন পরিণত হয়েছে ভয়ংকর দুঃস্বপ্নে।

ভালো বেতনের চাকরির আশ্বাস দিয়ে পাচারকারী চক্রের দালাল জামাল কারিগর ও তার সহযোগীরা মাদারীপুরের পাঁচ যুবকের কাছ থেকে কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব যুবককে লিবিয়ায় পাঠিয়ে সেখানে বন্দি করে নির্যাতনের মাধ্যমে পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করেছে চক্রটি।

ভয়ংকর বাস্তবতা

ভুক্তভোগীদের পরিবার জানায়, লিবিয়ায় আটকে রেখে যুবকদের হাত-পা বেঁধে ভয়াবহ নির্যাতনের ভিডিও ও ছবি পাঠিয়ে আদায় করা হয় মুক্তিপণ। কেউ কেউ শরীরে ক্ষতের সঙ্গে পোকাও ধরেছে। অনেক পরিবার জমি-ভিটা বিক্রি করে ছেলেকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়নের ঘুনসি গ্রামের মাদারীপুর সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র হাসান হাওলাদার ২০২২ সালে স্থানীয় দালাল জামাল কারিগরের সঙ্গে ১৩ লাখ টাকায় স্পন্সর ভিসায় ইতালি যাওয়ার চুক্তি করেন। প্রথমে তাঁকে দুবাই, পরে লিবিয়ায় নেওয়া হয় এবং সেখানে মাফিয়াদের হাতে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এরপর আরও ৫ লাখ টাকা আদায়ের জন্য শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন। বর্তমানে তাঁর কোনো খোঁজ নেই।

একই গ্রামের রুহুল শেখ লিবিয়ায় পাচারকারীদের নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছেন। মিন্টু হাওলাদার, মিঠু দাস ও বৃদ্ধ শাহ আলমসহ আরও অন্তত ৫০ জন একই ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। মিন্টুকে জীবিত ফেরত আনতে তাঁর পরিবারকে দিতে হয়েছে ২০ লাখ টাকা।

ক্ষমতার ছত্রছায়ায় দালালচক্র

স্থানীয়দের অভিযোগ, জামাল কারিগর দীর্ঘদিন ধরে মানবপাচার চক্রের হয়ে কাজ করছেন। তিনি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। মামলা করেও অনেকে উল্টো জেল খেটেছেন।

হাসান হাওলাদারের বাবা হায়দার হাওলাদার বলেন, “ছেলেকে লিবিয়ায় আটকে রেখে ১৫ লাখ টাকা নিয়েছে জামাল। মামলা করলে সে উল্টো আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে পাঠায়।”

শাহ আলম বলেন, “জামাল ১২ লাখ টাকা নিয়ে লিবিয়ায় পাঠিয়ে আমাকে মরুভূমিতে আটকে রেখে চাবুক দিয়ে পেটায়। আমি তার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।”

মিন্টুর মা সাবিনা বেগম বলেন, “জামাল আমার ছেলেকে মাফিয়ার কাছে বিক্রি করেছে। এমন শত শত ছেলের জীবন নষ্ট করেছে।”

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জামাল কারিগরের বিরুদ্ধে মাদারীপুরের বিভিন্ন থানায় ১০টিরও বেশি মামলা রয়েছে। জামিনে মুক্তি পেয়েই সে হয়ে ওঠে আরও বেপরোয়া।

তবে জামাল কারিগর এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমি ব্যবসায়ী মানুষ। আমার ছেলে ইতালিতে আছে। কারও বিরুদ্ধে হুমকি দিইনি, আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে।”

মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর সাহা বলেন, “মানবপাচার চক্রের দালালদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।”

সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াদিয়া শাবাব বলেন, “স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে মানবপাচারকারীদের একটি তালিকা প্রস্তুত করেছে। এসব নাম জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে টাঙিয়ে দেওয়া হবে, যাতে সবাই সতর্ক হয়।”



banner close
banner close