গোধূলির ম্লান আলোয় চাঁপাইনববাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার বাজারপাড়া গ্রামটি যেন একটু বেশিই শান্ত, একটু বেশিই ধ্যানমগ্ন। এই নির্জন গ্রামেই বসবাস করছেন একজন ক্ষীণকায় বৃদ্ধ, যার চোখে এখনো স্বপ্নের দীপ্তি, কণ্ঠে আধ্যাত্মিক উচ্চারণের ধ্বনি। বয়স প্রায় ৭৫ ছুঁই ছুঁই, শরীর কিছুটা ন্যূজ হলেও মন তাঁর অদ্ভুতরকম প্রাণবন্ত। তিনি মুহাঃ মোফাজ্জল হোসেন বিশ্বাস—একজন কবি, এক মননশীল সমাজভাবুক, যিনি নীরবে-নিভৃতে গড়ে তুলেছেন সাহিত্য ও মানবিকতার এক সমন্বিত মহাশালা।
২০০০ সালে নিজের জমিতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘মন্তাজ আলী বিশ্বাস সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদ ও সাধারণ পাঠাগার’। শুধু পাঠাগার বললে হয়তো এর পরিচয় পূর্ণ হয় না। এটি একটি নীরব আলোর মিনার, যেখান থেকে আশপাশের মানুষ আশ্রয় পায় জ্ঞান, সাহিত্য ও নৈতিকতার ছায়ায়।
পাঠাগারের দেয়ালে দেয়ালে লেখা তাঁর নিজস্ব রচিত বাণী, যা চিন্তাশীল পথিকের চোখ আটকে দেয় সহজেই। একটি দেয়ালে লেখা—
“সন্তান জন্ম দিলেই ভালো পিতা-মাতা হওয়া যায় না, ভালো পিতা-মাতা হওয়া বড়ই কঠিন।”
আরেকটি দেয়ালে—
“মানব জীবনের পরিচয় মানবতার গুণে, ঈর্ষা পরায়ণ অবুঝের সাথী, নিজের অকল্যানে।”
এসব শুধু শব্দের খেলা নয়—এসব হচ্ছে জীবনের বাস্তব উপলব্ধি, যা তিনি জীবনের অভিজ্ঞতায় অর্জন করেছেন এবং এখন ছড়িয়ে দিচ্ছেন সমাজে।
সাহিত্যচর্চায় নিঃস্বার্থ নিবেদন-
কবির রচনার ঝুলিতে রয়েছে তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ— ‘অন্তর্দৃষ্টি’, ‘বৈচিত্র্যের মাঝে আমি’, ‘করণীয় জীবনের স্মরণীয় বাণী’। প্রতিটি গ্রন্থেই তিনি অনুসন্ধান করেছেন মানব-চেতনার গভীর প্রদেশ, আধ্যাত্মিকতা ও আত্মানুসন্ধানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। বইগুলোয় উঠে এসেছে নৈতিক সংকট, আত্মিক দুর্দশা ও সমাজের মূল্যবোধবিচ্যুতি নিয়ে তাঁর গভীর বেদনা ও প্রত্যাশা। বর্তমানে তাঁর কয়েকটি পাণ্ডুলিপি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
তাঁর লেখার মূল উপজীব্য তাই—মানুষের আত্মার সন্ধান, মানবিকতার জাগরণ ও চেতনার পুনর্জাগরণ।
‘উন্মীলন’ নিয়ে আশা ও হতাশার কথা-
পাঠাগার থেকে ২০১৩ সালের মার্চে প্রকাশিত হয়েছিল একটি সাহিত্যপত্রিকা, যার নাম ‘উন্মীলন’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা। তিনি নিজে এর সম্পাদকীয় পরিষদের সভাপতি ছিলেন। তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত এই পত্রিকার মাধ্যমে স্থানীয় সাহিত্যচর্চায় এক গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। কবির মতে, “সাহিত্য শুধু ব্যক্তিগত পরিতৃপ্তি নয়—এটি সমাজের দর্পণ। আমি সকল অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে লিখনীল মাধ্যমেই প্রতিবাদ করতে চাই।”
‘কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম কেন যেন সাহিত্য বিমূখ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন’ বলে হতাশার কথা জানাচ্ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ‘উন্মীলন’ নিয়ে তেমন আর অগ্রসর হতে পারেন নি।
জীবনবোধ ও আধ্যাত্মিকতা-
মুহাঃ মোফাজ্জল হোসেন বিশ্বাস শুধু কলমচালিত কবি নন, তিনি এক অর্থে দার্শনিক, যিনি শব্দের পরতে পরতে মানুষের আত্মার খোঁজ করেন। তিনি বিশ্বাস করেন—জীবনের সব উত্তর বাহ্যিক জগতে নেই, কিছু প্রশ্নের জবাব লুকিয়ে থাকে অন্তরজগতে। তাই তাঁর কবিতায় যেমন স্থান পায় প্রেম, প্রকৃতি ও প্রতিবাদ, তেমনি প্রবলভাবে ফুটে ওঠে পরমাত্মা, মানবিকতার দর্শন এবং আত্মজিজ্ঞাসা।
একটি বাণীতে তিনি লেখেন—
“জীবনের জয়গান খোঁজে কল্যাণের ফাঁকে, চেতনায় অবগাহি জীব জগতের লাগি, সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টার প্রকাশ আমি তা মাগি।”
এই উচ্চারণই তাঁর কবিতার সারমর্ম—এক ধরনের সৃষ্টিশীল ধ্যানমগ্নতা।
সময়ের নিঃশব্দ সৈনিক-
বহু কবি সাহিত্যিক সময়ের আলোয় আলোচিত হয়েছেন। কিন্তু মুহাঃ মোফাজ্জল হোসেন বিশ্বাস কখনো প্রচারের আলোতে আসেননি। তিনি যেমন শান্ত প্রকৃতির, তেমনি নিজের কাজ নিয়েই সন্তুষ্ট। নিজের অর্জিত সম্পদ ব্যয় করে গড়ে তুলেছেন পাঠাগার, তার রক্ষণাবেক্ষণ, বই সংগ্রহ, পত্রিকা প্রকাশ—সবই নিজ অর্থায়নে পরিচালিত।
এই নিঃস্বার্থ নিবেদন আজকের সমাজে এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। কেউ বলতেই পারেন, তিনি একাই যেন একটি প্রতিষ্ঠান।
সাধারণ মানুষ, অসাধারণ চিন্তা-
যাঁরা তাঁকে কাছ থেকে চেনেন তাঁরা বলেন, “তিনি সাদামাটা, বিনয়ী, অথচ চিন্তায় অসাধারণ।” তরুণদের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি কোনোদিন ক্লান্ত হন না। বরং নতুন প্রজন্মকে মানুষের মতো মানুষ হতে, সমাজের জন্য কিছু করতে সবসময় উৎসাহ দিয়ে থাকেন।
তাঁর মতে, “লেখক হতে হলে আগে মানুষ হতে হয়। নীতির জায়গা থেকে না লিখলে তা আর কেবল কাগজে লেখা হয়ে থাকে—জীবনে নয়।”
শেষ কথা-
এই সময় যখন মানুষ নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, তখন মুহাঃ মোফাজ্জল হোসেন বিশ্বাস একজন নিঃশব্দ যোদ্ধা হয়ে পথ দেখাচ্ছেন। সাহিত্যের প্রতি তাঁর প্রেম, সমাজের প্রতি তাঁর দায়িত্ববোধ, এবং আত্মার প্রতি তাঁর অনুসন্ধান তাঁকে করে তুলেছে ব্যতিক্রমধর্মী এক মানুষ।
বাজারপাড়ার মাটির গন্ধে, ‘উন্মীলন’-এর পাতায়, দেয়ালে লেখা বাণীতে, কিংবা তাঁর চোখের দৃষ্টিতে—সবখানেই আছে এক ধরনের ত্যাগ, নির্লোভতা ও আধ্যাত্মিকতা। তিনি যেন এক আলোকবর্তিকা, যাঁর আলোয় আলোকিত হতে পারে যেকোনো চিন্তাশীল পথিক।
আরও পড়ুন:








