রবিবার

২১ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৬ পৌষ, ১৪৩২

বাউফলে পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার ডিজিটাল জালিয়াতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২০ জুলাই, ২০২৫ ১৬:৩৭

শেয়ার

বাউফলে পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার ডিজিটাল জালিয়াতি
ছবি সংগৃহীত

অফিসে না গিয়েও হাজিরা! পাঁচ মাসে অনুপস্থিত ৬৮ দিন- উধাও স্বাস্থসেবা। পটুয়াখালীর বাউফলের সরকারি এক কর্মকর্তা অনিয়মকে শিল্পে রুপান্তর করেছেন। দিনের পর দিন তিনি অফিসে আসেন না। কিন্তু রেকর্ড বলছে, প্রতিদিন দায়িত্বে ছিলেন তিনি। কিভাবে করলেন এই অসাধ্য সাধন! বিষয় নিয়ে খোঁজ গিয়ে জানা গেছে, অনিয়ম করতেই ভালোবাসেন উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সানজিদা ইসলাম জেসমিন। এ বছরেই ৬ মাসে ৬৮ কর্মদিবসই অনুপস্থিত তিনি।

জানা যায়, গর্ভবতী নারী ও নবজাতকদের স্বাস্থ্য সেবা প্রান্তিক পর্যায়ে মানুষের নিশ্চিত করে পরিবার পরিকল্পনা অফিস। স্বল্পমেয়াদি ও স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির জন্যও সেবাগ্রহিতাদের পছন্দের স্থান উপজেলার পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়। নিয়ম অনুযায়ী এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঠ পর্যায়েও কার্যক্রম পরিচালনার কথা। অথচ, বাউফল উপজেলায় এই অফিসের কার্যক্রম সম্পর্কে জানেনই না স্থানীয় জনগণ।

ঠিক কি কারণে মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম চলছে না তা খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাই অফিসে আসেন না। রেকর্ড অনুযায়ী গত ছয়মাসের বেশিরভাগ কর্মদিবসেই অনুপস্থিত অফিস প্রধান ডা. সানজিদা ইসলাম জেসমিন।

ভিডিও কলে বায়োমেট্রিক হাজিরা-

২০২৪ সালের জুন মাসে বিষয়টি প্রথম নজরে আসে। দীর্ঘসময় অনুসন্ধানের পরে গোপণ ক্যামেরায় ধরা পরে অনিয়মের চিত্র। দেখা যায়, অফিসে অনুপস্থিত থেকেও হাজিরা দিচ্ছেন ভিডিও বার্তায়! ঘটনাটি ডিসেম্বর ১১ ও ১২ তারিখের বাউফলেই ছিলেন না ডা. সানজিদা। যথাক্রমে, প্রথমদিন বিকেলে ৪টা ৪৫ ও পরের দিন ৪টা ৪৭ মিনিটে ফিরোজ খান হাজিরা মেশিনের সামনে এসে ভিডিও কলে যুক্ত করে একজনের হাজিরা নিশ্চিত করেন। কিছু সময় ব্যবধানে নিজেও হাজিরা দেন। ভিডিও কলে ডা. সানজিদাই ছিলেন তার প্রমাণ মিলেছে হাজিরা তালিকায়।

চলতি বছরে ৩ ফেব্রুয়ারি, সরেজমিনে বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়া হয়। তবে, তখন কেউ কথা বলেনি ক্যামেরায়। এরপরে ভিডিও কলে হাজিরা দেয়া বন্ধ করেন অভিযুক্ত কর্মকর্তা। এই সময়ের হাজিরা তালিকা সংগ্রহ করলে দেখা যায় বড় পরিবর্তন। ডা. সানজিদা ইসলাম জেসমিন ফেব্রুয়ারিতে অনুপস্থিত ৮ দিন, লেট ৯ দিন। মার্চ মাসে অনুপস্থিত ৭ দিন, লেট ৫ দিন। এপ্রিল মাসে অনুপস্থিত ১৭ দিন, লেট ৪ দিন, যথাসময়ে অফিস করেছেন মাত্র ১ দিন। মে মাসে অনুপস্থিত ১৪ দিন, লেট ৬ দিন, যথাসময়ে অফিস করেছেন মাত্র ১ দিন। জুন মাসে অনুপস্থিত ১৭ দিন, লেট ৪ দিন, যথাসময়ে অফিস করেছেন মাত্র ১ দিন। আর জুলাই মাসের ১৪ তারিখ পর্যন্ত অনুপস্থিত ৫ দিন, লেট ৫ দিন, সময়মতো আসেননি একদিনও। এদিকে, সরকারি বিধিমালা অনুযায়ী একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা সাপ্তাহিক ছুটির বাইরে বছরে ২০দিন প্রাপ্য ছুটি পাবেন।

এদিকে এসব বিষয় জানতে, ১৪ জুলাই দুপুর ১টায় অফিস গেলে তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখা যায়। সাংবাদিক আগমনের খবর পেয়ে ২টা ৩০ মিনিটে অফিসে পৌঁছান অভিযুক্ত সানজিদা। তবে কোনভাবেই ক্যামেরায় কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান তিনি।

অনুসন্ধানে উঠে আসে আরও বহু অভিযোগ। ভুক্তভোগী একজন নারী জানান, তার নয় বছরের সংসার ভেঙেছে ডা. সানজিদা। তার স্বামীর পরকিয়া প্রেম নিয়ে সংসারে প্রথমে বিরোধ হয়।পরে তার স্বামী কালাইয়া ইউনিয়নের কাপড় ব্যবসায়ী সজিব মুন্সি তার বিরুদ্ধে যৌতুক মামলা করেন। স্বামীর মামলায় নারীসহ তার পরিবারের সবাইকে আসামি করা হয়। আদালত থেকে মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সানজিদা। ভুক্তভোগী নারীর বাড়িতে তদন্ত হওয়ার কথা থাকলেও তাদের ডাকা হয় মদনপুরা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। সেখানে প্রথমেই ওই নারীকে বিচ্ছেদ করার পরামর্শ দেয় সানজিদা। রাজি না হলে দাবি করেন ঘুষ। তাতে রাজি না হওয়ায় ওই নারীকে উচ্চাবিলাসী এবং অর্থলোভী উল্লেখ করে রিপোর্ট দিয়ে দেন সানজিদা ইসলাম জেসমিন। ভুক্তভোগী নারী বলেন, বিচারতো পেলামই না, উলটো মামলায় হয়রানি পোহাচ্ছেন তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। এরকম অনেক তদন্তে ভুল রিপোর্ট দেয়া সানজিদার স্বভাব হয়ে গেছে।

অন্যদিকে, একাধিক স্টাফের সাক্ষর জাল করে পরিবার পরিকল্পনা সহকারী জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ পাঠানোর অভিযোগও আছে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। অফিসের তথ্য সাংবাদিকদের পৌঁছে দেন এমন সন্দেহে জাকিরের সাথে বিরোধ করেন অভিযুক্ত সানজিদা অভিযোগ করেন জাকির।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, পরিবার পরিকল্পনা অফিসের মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম প্রায় নেই বললেই চলে। গর্ভবতী নারীদের সেবা, নবজাতকের সেবা, সচেতনতামূলক কার্যক্রম কিংবা জনসম্পৃক্ততা কিছুই নেই তবুও বাজেট ব্যবহৃত হচ্ছে পুরোদমে। প্রতিমাসে মাঠ ভিজিট দেখিয়েও টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন সানজিদা ইসলাম জেসমিন। অভিযোগ রয়েছে, এসব বিষয় কথা বললে কিংবা বিরোধিতা করলেই স্টাফদের গালাগাল দেয়াসহ শোকজ করে থাকে অভিযুক্ত কর্মকর্তা সানজিদা ইসলাম জেসমিন।

সরকারি অফিস-আদালতের বেশিরভাগ মেশিনে ‘Liveness Detection’ প্রযুক্তি না থাকার সুযোগ নিয়ে থাকে সানজিদার মত অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সচেতন মহল বলছেন, প্রযুক্তির বিকাশ স্বচ্ছতা আনতে ব্যর্থ হলে, তা হয়ে ওঠে প্রতারণার হাতিয়ার। এই ঘটনা শুধু একজন কর্মকর্তার নয়এটা গোটা প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। জরুরি ভিত্তিতে জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে, এ অনিয়ম ছড়িয়ে পড়বে আরও গভীরে।

এ বিষয়ে পটুয়াখালী জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক শহীদুল ইসলাম বলেন, একটি তদন্ত হয়েছে৷ আরেকটি টিম সরেজমিনে তদন্ত করেবন। বায়োমেট্রিক হাজিরার জালিয়াতি ভয়াবহ অপরাধ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) সাজেদুর রহমান বলেন, হাজিরা টেম্পারিং, অসদাচরণ, অনুপস্থিত থাকাসহ সকল বিষয় তদন্ত হবে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে সানজিদা ইসলাম জেসমিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান।



banner close
banner close