নাম গেটম্যান—কিন্তু নেই কোনো গেট। নেই ছায়া, নেই বসার জায়গা, এমনকি নেই একটি রেইনকোটও। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সাত বছর ধরে নাটোরের বাগাতিপাড়ার ঠেঙ্গামারা রেলগেটে দায়িত্ব পালন করছেন আফসার উদ্দিন সোহাগ (৩২)।
২০১৯ সালে একটি সরকারি প্রকল্পের আওতায় অস্থায়ী গেটম্যান হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। শুরু থেকেই ছিল না কোনো স্থায়ী অবকাঠামো। বাঁশ দিয়ে তৈরি একটি অস্থায়ী মাচা ছিল, সেটিও বহু আগেই ভেঙে গেছে। এখন গাছতলায় দাঁড়িয়ে বা পাশের চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসেই সামান্য বিশ্রাম নেন তিনি।
ট্রেন আসার খবর পেলেই দৌড়ে যান রেললাইনের পাশে। হাতের ইশারায় থামান যানবাহন ও পথচারীদের। তাঁর দায়িত্বে প্রতিদিন শত শত মানুষ নিরাপদে পার হন রেলক্রসিং। অথচ নিজের নিরাপত্তা ও মানবিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কেউ ভাবেনি।
সোহাগ বলেন,
“সাত বছর ধরে ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে ডিউটি করছি। একটা টিনের ছাউনি তো দূরের কথা, বাঁশের মাচাটাও ছিল—সেটাও এখন আর নেই।”
এই রেলগেট সংলগ্ন এলাকাতেই রয়েছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক ও একটি ব্যস্ত বাজার। ফলে এই লেভেল ক্রসিং দিয়ে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক মানুষ চলাচল করে। অথচ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যিনি প্রাণপণ চেষ্টা করছেন, তিনিই রয়েছেন অবহেলিত।
এক সময় এখানে তিনজন গেটম্যান দায়িত্ব পালন করতেন—সোহাগ, সাইফুল ও রিয়াজুল। জাতীয়করণ ও বেতন কাঠামোর উন্নয়ন না হওয়ায় রিয়াজুল দায়িত্ব ছেড়ে চলে যান। এখন সোহাগ ও সাইফুল মিলে ১২ ঘণ্টা করে পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন।
স্থানীয় বাসিন্দা আকরাম হোসেন বলেন,
“এভাবে দুজন মানুষ ঝড়-বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকে! আমরা নিজেরাই লজ্জা পাই। অথচ কোনো দুর্ঘটনা হলে সবাই ছুটে আসবে প্রশ্ন করতে—কিন্তু সাত বছরেও কেউ কোনো উত্তর খুঁজলো না।”
এ বিষয়ে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক ফরিদ আহমেদ জানান,
“আমি বিষয়টি জানতাম না। এখন খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।”
তবে এখানেই প্রশ্ন—এই খোঁজটা সাত বছরে একবারও নেওয়া হয়নি কেন?
গেটম্যান সোহাগের কাহিনি আসলে ব্যতিক্রম নয়—এটি বাংলাদেশের বহু নিম্ন আয়ের কর্মজীবীর বাস্তবতা। দায়িত্ব যাঁদের কাঁধে, তাঁদের দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই।
সোহাগের চোখে আজও ভরসা আছে। কিন্তু সেই আশার আলো আদৌ আসবে তো?
আরও পড়ুন:








