সমুদ্রতীরে পড়ে থাকা একটি ফাঁকা পানির বোতল যেন একটি পুরো ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি। কিছুক্ষণ আগেও যা ছিল কারও হাতে, তা এখন পড়ে আছে সৈকতের বালুর ওপর। সেখানে থেকে স্রোতের টানে, জোয়ার-ভাটার খেলায় ধীরে ধীরে সেটি পৌঁছে যায় সাগরের গভীরে।
তবে এখানেই বোতলের যাত্রার শেষ নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি প্লাস্টিক বোতল স্বাভাবিক পরিবেশে ৫০০ বছরেও অবলুপ্ত হয় না। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি, ঢেউয়ের ঘর্ষণ, লবণাক্ত পানি ও বালুর সংমিশ্রণে এক সময় তা ভেঙে যায় মাইক্রোপ্লাস্টিকে। ৫ মিলিমিটার বা তার চেয়েও ছোট এসব কণা খেয়ে ফেলে সামুদ্রিক মাছ, কাছিমসহ বহু প্রাণী। পরবর্তীতে মাছের মাধ্যমে এসব কণা চলে আসে মানুষের শরীরেও, যার থেকে হতে পারে ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগ।
স্রোতের টানে সাগরে, আর সেখান থেকে মানুষের শরীরে। সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সুলতান আল নাহিয়ান বলেন, একটি বোতলের মাধ্যমে আমরা হাজার হাজার বোতল, চিপসের প্যাকেট, ওয়ানটাইম কাপসহ বিভিন্ন প্লাস্টিক বর্জ্যের কথাই বলতে চাইছি। যা প্রতিদিন অবচেতনভাবে ফেলা হচ্ছে।
দায় আছে ব্যবস্থাপনাতে:
কক্সবাজারে প্রতিদিনই আসে হাজার হাজার পর্যটক। তাদের অনেকেই সমুদ্রসৈকতে খাওয়া-দাওয়া শেষে প্লাস্টিক বোতল বা প্যাকেট ফেলে যান যত্রতত্র। অভিযোগ আছে, সৈকতজুড়ে ডাস্টবিনের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। ভোক্তারা বলছেন, ডাস্টবিন না থাকায় বাধ্য হয়েই আমরা প্যাকেট বা বোতল ফেলে দিই।
সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের দৌরাত্ম্য:
সৈকতের আশপাশে চা, পানি, ফাস্টফুড বিক্রির প্রায় সব পণ্যই পরিবেশন করা হয় একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকে। নানা আন্দোলন ও প্রতিশ্রুতি থাকলেও এখন পর্যন্ত এর কার্যকর বিকল্প আসেনি। কাগজের কাপ কোথাও কোথাও ব্যবহার হলেও, পানির বোতলের কোনো বিকল্প দেখা যায় না।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্বে) জসিম উদ্দিন বলছেন, আমরা অন্তত সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বন্ধ করতে চাই। কিন্তু বাস্তবচিত্র বলছে, পরিকল্পনা থাকলেও মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন অনুপস্থিত।
বাঁকখালীতে বর্জ্যের পাহাড়, দায়হীন প্রশাসন-
প্রতিদিন কক্সবাজার শহরে উৎপাদিত বর্জ্যের পরিমাণ ১২৪ টন, যার বেশিরভাগই প্লাস্টিক। এই বর্জ্যের একটি বড় অংশ পৌর এলাকার বিভিন্ন ড্রেন, খাল ও নালা দিয়ে গিয়ে পড়ে বাঁকখালী নদীতে। পরে তা নদীর মাধ্যমে সাগরে মিশে যায়।
নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়েও আছে বড় প্রশ্ন। বাঁকখালী নদীর তীরে এক জায়গায় বর্জ্য জমিয়ে তৈরি হয়েছে এক বিশাল বর্জ্যের পাহাড়। দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এখান থেকে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য-অথচ নির্বিকার পৌরসভা, পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন।
আশঙ্কাজনক চিত্র সারা দেশের
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য নদীর মাধ্যমে গিয়ে পড়ে বঙ্গোপসাগরে। বছরে যার পরিমাণ প্রায় ২৬.৬ মিলিয়ন টন। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত ও মিয়ানমার থেকেও প্রচুর প্লাস্টিক বর্জ্য যাচ্ছে সাগরে।
গবেষকদের মতে, খালি চোখে না দেখা গেলেও সৈকতের বালুর নিচে জমে আছে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক। বর্ষায় তা কিছুটা দৃশ্যমান হলেও, বছরের বাকি সময় থাকে বালু ও জোয়ারে আড়াল হয়ে।
প্লাস্টিকের এই নীরব সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে প্রকৃতি, প্রাণী এবং মানুষ সবার ভবিষ্যৎ। একটা ফেলে দেওয়া বোতল থেকে তৈরি হচ্ছে একটি ভয়াবহ চক্র। কক্সবাজারের মতো শহরে যেখানে পরিবেশ-পর্যটন দুই-ই অর্থনীতির প্রাণ, সেখানে এমন আত্মঘাতী ব্যবস্থাপনা কতদিন চলবে এই প্রশ্ন উঠছে প্রতিটি সচেতন কণ্ঠে।
আরও পড়ুন:








