
গত ৯ জুন রাত ১০টার দিকে কুষ্টিয়া পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনের ভবনের গ্যারেজে প্রয়াত সাবেক এমপি আনারের কোটি টাকার প্রাডো ব্র্যান্ডের গাড়ির সন্ধান পান স্থানীয়রা৷ পরেরদিন দুপুরের দিকে গাড়িটি উদ্ধার করে থানায় রাখে পুলিশ।
গাড়িটি সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেল ও চট্রগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা লিটনের নকল সিগারেট তৈরির চক্রের হেফাজতে ছিল। গাড়িটি উদ্ধারের পর উধাও হয়ে গেছে চক্রটির সদস্যরা সহ তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। নিরাপত্তা কর্মী ছাড়া ওই ভবনের অফিসে আসেন না কেউ৷ এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় কাউকে আটকও করতে পারিনি পুলিশ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় তিন মাস আগে কুষ্টিয়া শহরের মজমপুর এলাকায় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে ৮ তলা বিশিষ্ট সাফিনা টাওয়ারের গ্যারেজে ভারতে খুন হওয়া ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের গাড়ি রাখেন নকল সিগারেট তৈরির চক্রের কুষ্টিয়ার হর্তাকর্তারা৷ ওই ভবনের সাতটি ইউনিট ও গাড়ি পার্কিং জোন ভাড়া নেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি মেহেরপুরের গাংনী পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি। গাড়ি উদ্ধারের পর থেকে মোস্তাফিজুরসহ কর্মকর্তা, কর্মচারী ও চক্রের সদস্যরা উধাও হয়ে গেছেন। ভবনের নিরাপত্তাকর্মী ও স্থানীয় সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাবেক বিএনপি নেতা মোস্তাফিজুর রহমান ‘জেনুইন লিফ কোম্পানি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক। তার বাড়ি মেহেরপুরের গাংনী পৌরসভার বাঁশবাড়িয়ায়। এই কোম্পানির নাম ৫ আগস্টের আগে ছিল ‘তারা টোব্যাকো’। পরে কোম্পানির নাম ও মালিকানা পরিবর্তন হলেও কর্মকর্তা একই থাকেন। এর মহাব্যবস্থাপক (জিএম) বিল্লাল হোসেন।
সরেজমিনে সাফিনা টাওয়ারে গিয়ে দেখা মেলে নিরাপত্তারক্ষী আলমগীর হোসেনের। তিনি বলেন, প্রায় এক বছর আগে ১ জুলাই মোস্তাফিজুর রহমান ভবনের তিনটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। পরে পর্যায়ক্রমে আরও চারটি ফ্ল্যাট ও পার্কিং জোন ভাড়া নেন। তিনি তামাক কোম্পানি এই অফিসের সবচেয়ে বড় পদে রয়েছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, মোস্তাফিজুর স্যার গাড়িটি এখানে প্রায় তিন মাস আগে আনান। তার গাড়ি চালক দিয়ে পার্কিংয়ে এনে রাখেন। এখানেই রাখা ছিল, বাইরে বের করা হতো না। সব সময় ঢেকে রাখা হতো, শুধু মাঝে মধ্যে স্টার্ট দেওয়ার সময় সেটি খোলা হতো। হঠাৎ জানাজানি হয় যে, গাড়ির মালিক ভারতে খুনের আনার এমপির। জানাজানির একদিন পরে গাড়িটি উদ্ধার করে নিয়ে গেছে পুলিশ। এরপর থেকে এই অফিসের বড় স্যাররা এবং কর্মকর্তারা অফিসে আসেন না। কোম্পানির অন্য গাড়িগুলোও নিয়ে গেছেন তারা।
মোস্তাফিজুর তার পরিবার নিয়ে চলে গেছেন। তিনিও আর আসেন না। এটা আগে তারা কোম্পানি ছিল। ৫ আগস্টের পর জেনুইন কোম্পানি হয়েছে।
কুষ্টিয়ার ত্রিমোহনী এলাকায় তাদের আরেকটি অফিসে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, অফিসে কোনো কর্মকর্তা নেই। নিরাপত্তাকর্মীসহ দুজন কর্মচারী রয়েছেন। নিরাপত্তাকর্মী ফজলুল শেখ ও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী বলেন, এটির নাম আগে তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো ছিল। ৫ আগস্টের পর জেনুইন লিফ টোব্যাকো নামকরণ করা হয়েছে। অফিসের কার্যক্রম সবমিলিয়ে ভালো ভাবেই চলছিলো। কিন্তু পুলিশ লাইনের সামনের অফিস থেকে একটি গাড়ি উদ্ধারের পর থেকে কর্মকর্তারা অফিসে আসেন না।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য মোস্তাফিজুর ও অফিসের কর্মকর্তাদের পাওয়া যায়নি৷ মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলেও রিসিভ করেনি তারা।
জানা গেছে, বিজয় টোব্যাকো ও তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোর মাধ্যমে নওফেল ও লিটন রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে লোপাট করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। ৫ আগস্টের পর ঢাকায় তাদের একাধিক কারখানায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ এই রাজস্ব ফাঁকির প্রামাণ পায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর সাবেক মন্ত্রী নওফেল ও সাবেক প্যানেল মেয়র লিটন পালিয়ে গেলেও কুষ্টিয়া অঞ্চলে থেমে নেই তাদের অবৈধ ব্যবসা। পরিবর্তিত পেক্ষাপটে বিএনপি নেতাদের ছত্রছায়ায় আবারো বেপরোয়া আওয়ামীপন্থি এই সিন্ডিকেট। রাতারাতি পরিবর্তন করা হয়েছে তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোর নাম। ‘তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো’ হয়ে গেছে ‘জেনুইন টোব্যাকো’। তবে নতুন নামে কার্যক্রম শুরু হলেও একই অফিসে একই কর্মকর্তারা কর্মরত রয়েছেন। কুষ্টিয়ায় অবস্থিত অফিস ও কারখানাগুলোর নামও পরিবর্তন করা হয়েছে। আড়িয়া ইউনিয়নের বড়গাংদিয়ার জহুরাগঞ্জ ও ভেড়ামারা উপজেলার ১২ মাইল এলাকাতেও এই কোম্পানির কারখানা রয়েছে।
জেনুইন লিফ টোব্যাকো কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী বলেন, বর্তমানে কুষ্টিয়া অঞ্চলে জেনুইন লিফ টোব্যাকো কোম্পানির সব কিছু দেখভাল করেন তিনজন কর্মকর্তা। তারা হলেন, সিইও জাহিদ, জিএম বেলাল হোসেন ও নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। এ অঞ্চলে নওফেল সিন্ডিকেটের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করছেন এই তিন কর্মকর্তা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেল ও তার ব্যবসায়িক পার্টনার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সবুর লিটন। ৫ আগস্ট পর আত্মগোপনে থেকে নওফেল ও লিটন নানা কৌশল টিকিয়ে রেখেছেন নকল সিগারেট তৈরির ব্যবসা। আওয়ামী লীগের পরিবর্তে অবৈধ ব্যবসার শেল্টার দিচ্ছেন বিএনপি নেতারা। স্থানীয় বিএনপি নেতাদের ছত্রছায়ায় কুষ্টিয়ার তিন উপজেলায় নওফেল ও লিটন সিন্ডিকেট নতুন কৌশলে একাধিক অফিস ও কারখানা চালু করেছে। এমনকি তাদের কোম্পানিতে বিএনপির একাধিক নেতাকর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলেও একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, মিরপুর ও সদর উপজেলার কয়েকটি জায়গায় নামে-বেনামে ও গোপনে টোব্যাকো কোম্পানির নাম ব্যবহার করে নকল গোল্ডলিফ ও বেনসন সিগারেট তৈরি করা হয়। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের প্রতাবপুর এলাকায় ভারগন টোব্যাকোর স্বত্বাধিকারী রাইসুল হক পবন। বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এমপি ও নেতাদের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর ধরে নকল সিগারেট তৈরি করে আসছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের নেতাদের ছত্রছায়ায় নকল সিগারেট তৈরি করেছেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পরও আওয়ামী লীগের দোসর পবনের নকল সিগারেট তৈরির কারখানা বন্ধ হয়নি। কোটি টাকার বিনিময়ে উপজেলার প্রভাবশালী বিএনপি নেতাদের ম্যানেজ করেছেন। বর্তমানে তাদের ছত্রছায়ায় নকল সিগারেট তৈরি করা হয়। অবৈধভাবে নকল সিগারেট তৈরির মাধ্যমে দেশ-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন পবন।
অবৈধ সিগারেট উৎপাদনের দায়ে বেশ কয়েকবার এ কোম্পানির নামে মামলা হয়। এছাড়াও একাধিকবার অভিযান চালিয়ে নকল সিগারেট এবং ব্যান্ডরোল উদ্ধার করা হয়। এছাড়া কোম্পানির কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পবন আগে আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী-নেতাদের হেফাজতে ছিলেন। বর্তমানে বিএনপির প্রভাবশালী নেতার হেফাজতে রয়েছেন। সব কিছু ম্যানেজ করে নির্বিঘ্নে নকল সিগারেটের কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন পবন।
এবিষয়ে কথা বলার জন্য ভারগন টোব্যাকোর স্বত্বাধিকারী রাইসুল হক পবনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অর্থ ও প্রশাসন) ফয়সাল মাহমুদ বলেন, এ ধরনের কোনো সিন্ডিকেটের সুনির্দিষ্ট তথ্য পুলিশের কাছে নেই। তবে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করছে পুলিশ। গাড়িটি কারা কীভাবে এখানে এনেছে, সব কিছু মাথায় নিয়েই পুলিশ কাজ করছে।
প্রয়াত এমপি আনারের কন্যা মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বলেন, কুষ্টিয়াতে ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো ব্র্যান্ডের যেই গাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে। সেই গাড়িটি আমার বাবার। সংসদ সদস্য হিসেবে শুল্কমুক্তভাবে গাড়িটি আমদানির করা হয়েছিল। আমরা গাড়িটি পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছি। এজন্য যে যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার সেগুলো আমরা নিচ্ছি।
এবিষয়ে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. তৌফিকুর রহমান বলেন, আমরা নকল সিগারেট তৈরির সন্ধান বা অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করি। যদি কেউ বা কোনো প্রতিষ্ঠান নকল সিগারেট তৈরি করে। তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আরও পড়ুন: