সোমবার

১২ মে, ২০২৫
২৯ বৈশাখ, ১৪৩২
১৪ জিলক্বদ, ১৪৪৬

হরিরামপুরে পদ্মা ভাঙন রোধে কাজে আসছে না জিও ব্যাগ, স্থায়ী বেরিবাঁধের দাবি এলাকাবাসীর

জ. ই. আকাশ, হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ 

প্রকাশিত: ১২ মে, ২০২৫ ১১:২৮

শেয়ার

হরিরামপুরে পদ্মা ভাঙন রোধে কাজে আসছে না জিও ব্যাগ, স্থায়ী বেরিবাঁধের দাবি এলাকাবাসীর
কুশিয়ারচর পদ্মার ভাঙন। ছবি: বাংলা এডিশন

পদ্মার ভাঙনরোধে টিকসই হচ্ছে না জিও ব্যাগ। অনেক জায়গা ভাঙন দিলে জিও ব্যাগসহ ধসে যাচ্ছে। এমনই অভিযোগ মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের নদী পদ্মাপাড়ের মানুষের। সম্প্রতি নদীতে জোয়ারে পানি না আসতেই আবারও ভাঙন আতংক দেখা দিয়েছে পদ্মাপাড়ে বসবাসকারী জনগণের মাঝে। নদীর মাঝ দিয়ে অসংখ্য ডুবোচরসহ বড় বড় চর জেগে উঠায় নদীতে বৈশাখ মাসের শেষে দিকে জোয়ার পানি আসা শুরু হলেই নদী তীরবর্তী এলাকা দিয়ে পানি প্রবাহের আশংকা রয়েছে। এতে করে আবারও তীব্র নদী ভাঙনের কবলে পরতে পারে বলে পদ্মাপাড়ের শতশত মানুষের মাঝে এমন আতংক বিরাজ করছে। ভাঙনরোধে স্থানীয়দের একটাই দাবি স্থায়ী বেরিবাঁধ নির্মাণ।

রোববার উপজেলার কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের কুশিয়ারচর কালিতলা এলাকার পদ্মা তীরবর্তী বসবাসকারী একাধিক নারী পুরুষের সাথে কথা বললে ভাঙন আতংকের বিষয়টি তুলে ধরেন এবং স্থায়ী বেরিবাঁধের দাবি করেন তারা।

জানা যায়, এ উপজেলায় প্রায় পঞ্চাশ দশক থেকে অনবদ্য নদী ভাঙনের ফলে ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯ ইউনিয়নই নদী ভাঙনের কবলে পড়ে। আজিমনগর, সুতালড়ী ও লেছড়াগঞ্জ তিনটি ইউনিয়ন সম্পূর্ণভাবে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। পরবর্তীতে এই তিন ইউনিয়নে চর জেগে উঠলে নব্বই দশকের শেষ দিকে জনবসতী গড়ে ওঠে। ভাঙন কবলিত অন্যতম আরেকটি ইউনিয়ন কাঞ্চনপুর। এ ইউনিয়নের ১৩টি মৌজার মধ্যে ১২টি মৌজা সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয় গেছে। এতে করে এই ইউনিয়নেরই প্রায় ১২টি গ্রাম পুরোপুরি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এখনও প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে নতুন জোয়ারের পানি আসতে না আসতেই নদীর তীব্র স্রোতে নদীর পাড় ধসে ভাঙন দেখা দেয়। প্রতি বছরই বিলীন হচ্ছে বসতবাড়িসহ ফসলি জমি। এতে বসতভিটা জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে নদী পাড়ের শতশত পরিবার। বাপ-দাদার ভিটেবাড়ি জমিজমা হারিয়ে অনেকে এখন অন্যের জায়গা ভাড়া নিয়ে কোনোরকমে মাথাগুঁজে বসবাস করছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের মালুচী এলাকা নদীর তীর থেকে আধা কিলোমিটার দূরত্ব থেকেই নদীতে অসংখ্য ডুবোচরসহ বড় আকৃতির চর জেগে উঠেছে। এলাকার জনগণ আশংকা করছেন জোয়ারের পানি আসার সাথে সাথেই নদীর তীর ঘেঁষেই পানি তোড় দেখা দিতে পারে। এতে আবার এ এলাকায় ভাঙনের সম্ভব না রয়েছে। এছাড়াও নদীর তীরবর্তী এলাকা থেকে রাতের আঁধারে অবৈধভাবে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর তীর ঘেঁষে গভীরতা দেখা দিয়েছে বলেও অনেকে অভিযোগ করেন। তবে অধিকাংশ জায়গায় আপদকালীন জিও ব্যাগ ফেললেও জোয়ারের পানির তোড়ে অনেক জায়গায় জিও ব্যাগসহ ধসে ভাঙন দেখা দেয়। আবার কিছু জায়গায় এখনও কোনো জিও ব্যাগও পরেনি।

কুশিয়ার চর গ্রামের বাসিন্দা আইয়ুব খান জানান, প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে আমার বাপ-দাদার বসতবাড়ি, জমিজমা পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। প্রায় আশি বিঘা ফসলি জমিসহ বসতভিটা পদ্মায় যাওয়া সর্বস্ব হারিয়ে এখন আমরা একেবারে নদীর তীরে বসবাস করছি। আমাদের এখানে পানি আসে পশ্চিম দিক থেকে। সামনে আষাঢ় মাসে জোয়ারের পানি আসা শুরু হলে আবারও ভাঙন দেখা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জিও ব্যাগে আসলে ভাঙন সাময়িকভাবে রোধ করা গেলেও মূলত এখানে স্থায়ী বেরিবাঁধ ছাড়া আমাদের এলাকা রক্ষা করা যাবে না। এবার  ভাঙন দেখা দিলে আমার আর এই বাড়ি টুকু থাকবে না। শুধু আমি একা না, এই এলাকার শতশত পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাবে। তাই সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি ভাঙনরোধে স্থায়ী বেরিবাঁধ নির্মাণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

একই গ্রামের বাবুল গায়ানের স্ত্রী সালমা বেগম জানান, আমাগো বাড়ি প্রথম ভাঙছে বিশ বছর আগে। তার পর দ্বিতীয় ভাঙ্গা দিছে প্রায় দশ বছর আগে। সর্বশেষ ভাঙছে পাঁচ বছর আগে। বসতবাড়ি জমিজমা হারিয়ে আজ আমরা পথের ফকির। এখন মানুষের জায়গায় আছি। এ জায়গাটুকুও কখন জানি চলে যায়।

সমেজদ্দিন বেপারী জানান, আমাগো বাড়ি ১২ বছর আগে নদীতে চলে গেছে। এখন নদীর যে অবস্থা তাতে আষাঢ় মাসে জোয়ারের পানি আসতেই প্রতি বছর ভাঙন দেখা দেয়। আর কিছুদিন পরেই জোয়ারের পানি আসা শুরু হইব। তাই আমরা খুবই আতংকে আছি। এই জোয়ারের পানিতে যদি ভাঙন দেখা দেয়, তাহলে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি এই জায়গাটুকু থাকবে না। জিও ব্যাগে আসলে ভাঙন রোধ হয় সাময়িকভাবে। কিছুদিন পরে দেখা যায় জিওব্যাগসহ নদীতে চলে যায়। সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পরের জায়গা ভাড়া নিয়ে ঘর তুলে কোনোরকমে আছি। তাই আমাদের আসলে একটা স্থায়ী বেরিবাঁধ দাবি করছি।

বারেক গাজীর স্ত্রী মনোয়ারা জানান, চার/পাঁচ বছর আগে আমাগো বাড়ি পদ্মায় নিয়ে গ্যাছে। এখন নদীর পাড়ে বস্তা ফালাইছে এখানে দুই শতাংশ জায়গার ওপর একটা ছাপড়া তুইল্যা বসবাস করতেছি। গত বছর বর্ষা হয় নাই তাই টিকে আছে। এবার যদি বর্ষা হয়, তাহলে আর আমরা থাকতে পারব না। নদী জোয়ারের পানি আসা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই ভাঙন দেখা দেয়। তাই আমাগো একটা স্থায়ী ব্যবস্থা দরকার।
কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. জিয়াউর রহমান জানান, কুশিয়ারচর এলাকায় গত দুই বছর আগে ভাঙনরোধে আপদকালীন যে জিওব্যাগ ফেলেছিল। তা অনেকটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অনেক সময় জিও ব্যাগ নিয়ে ধসে যাচ্ছে। এই এলাকায় এখনো মালুচি গ্রামে কোনো জিও ব্যাগ পড়েনি। তাই জোয়ারের পানি আসতে না আসতেই ভাঙন দেখা দিচ্ছে। মূলত স্থায়ী বাঁধের ব্যবস্থা না হলে ভাঙনরোধ সম্ভব নয়। আমাদের একটাই দাবি একটা স্থানী বেরিবাঁধ।

এছাড়াও জোয়ারের পানির তোড়ে ভাঙন আতংকে রয়েছে চরাঞ্চলের আজিমনগর, সুতালড়ী ও লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের প্রায় ৫০ হাজার জনগোষ্ঠী। গত বছর তীব্র ভাঙনে শতশত বাড়িঘর ও আবাদি জমি বিলীন হয়ে বলে জানা যায়।

এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আক্তারুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন,  হরিরামপুর উপজেলার পদ্মা নদীর স্থায়ী ভাঙন হতে রক্ষার্থে প্রায় ১২.০০ কি:মি: জরিপ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ডিপিপি প্রনয়ণের জন্য ডিজাইন কাজ চলমান। তাছাড়া হরিরামপুর উপজেলার লেছড়াগঞ্জ, সুতালড়ি, আজিমনগর ইউনিয়ন যেন পদ্মা নদীর ভাঙনে কবলিত না হয়, সেজন্য ফিজিবিলিটি স্টাডি পূর্বক ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। সমগ্র জেলার নদী ভাঙন এলাকা সার্বক্ষনিক মনিটরিং জোরদার রয়েছে।

banner close
banner close