শনিবার

১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ ২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

সিংগাইর থানায় মামলা বাণিজ্য: ওসি প্রত্যাহার

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ৫ মার্চ, ২০২৫ ১৩:০৮

আপডেট: ৫ মার্চ, ২০২৫ ১৫:৩৪

শেয়ার

সিংগাইর থানায় মামলা বাণিজ্য:  ওসি প্রত্যাহার
ওসি মো: জাহিদুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

মানিকগঞ্জের সিংগাইর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীরকে প্রত্যহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। মঙ্গলবার (৪ মার্চ) বিকেলে মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মোছা: ইয়াসমিন খাতুন স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশের মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

জানা গেছে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারি শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর মানিকগঞ্জের সিংগাইরে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে থানায় একটি হত্যা মামলাসহ ৪টি মামলা দায়ের হয়। স্বৈরাচার হাসিনার দোসরদের সাথে আর্থিক চুক্তির মাধ্যমে তাদের গ্রেফতার না করে পাঁচ আগস্ট পরবর্তী সময়ে কর্মী সমর্থকদের গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের অধিকাংশই আসামি মামলার এজাহারে নাম না থাকায় অজ্ঞাত আসামি হিসেবে আটক করা হয় তাদের।

এজাহারে তাদের নাম না থাকলেও আটকের পর পুলিশ তাদের কাছে মোটা অংকের টাকা দাবী করেন। দেয়া হয় হত্যা মামলায় ফাঁসানোর হুমকি। চাহিদামতো টাকা দিলেই ফাঁড়ি ভাঙচুর কিংবা বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। না দিলে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে প্রেরণ করা হয়।

সিংগাইর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীর তার পছন্দের উপ-পরিদর্শক (এসআই) দিয়ে থানায় গড়ে তুলেন সিন্ডিকেট বাহিনী। তাদের দিয়েই গত ৬ মাসে কামিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা। ওসি ও তার সিন্ডিকেট বাহিনীর গ্রেফতার বাণিজ্যের তথ্য উঠে এসেছে বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক প্রতিবেদনে।

ওসির গড়ে তোলা সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরা হলেন- উপ-পরিদর্শক (এসআই) সুমন চক্রবর্তী, মুত্তালিব ও মাসুদুর রহমান। এদের মধ্যে এসআই সুমন চক্রবর্তীকে শিবালয় থানায়, এসআই মুত্তালিবকে দৌলতপুর থানায় ও এসআই মাসুদকে ঘিওর থানায় বদলি করা হয়েছে। এসআই সুমন চক্রবর্তী ও এসআই মুত্তালিব ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট থানায় যোগদান করলেও এসআই মাসুদুর রহমানকে বদলির পরেও ওসি বিশেষ ক্ষমতায় থানায় রেখে গ্রেফতার বাণিজ্য চালিয়ে যায়। এদিকে নানা অপকর্মে জড়িত থাকায় ওসি জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীরকে তিনবার শোকজ করার পর অবশেষে গ্রেফতার বানিজ্যর সত্যতা প্রমানিত হওয়ায় তাকে ক্লোজ করা হয় ।

গ্রেফতার বানিজ্য নিয়ে বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সিংগাইর থানায় কর্মরত এসআই সুমন চক্রবর্তী ওসি জাহিদুল ইসলামের যোগসাজশে বিভিন্ন মামলার অজ্ঞাতনামা আসামী হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তিকে আটক করে। আটক ব্যক্তিদের হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে দেয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের নিকট হতে মোটা অংকের উৎকোচ নিয়ে তাদেরকে জামীনযোগ্য মামলায় আটক দেখিয়ে আদালতে প্রেরণ করে।

বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে বেশ কিছু ঘটনার তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখিত বেশ কয়েকটি ঘটনার বিষয়ে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে তার সত্যতা পাওয়া যায়। গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে সিংগাইর থানার তালেবপুর ইউনিয়নের কাংশা গ্রামে মুক্তার হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে চুরির অপরাধে আটক করে স্থানীয়রা। এরপর রাতভর তাকে নির্যাতন করা হলে পরদিন সকালে তিনি মারা যান। এ ঘটনায় ১৫ সেপ্টেম্বর মামলা করেন মুক্তার হোসেনের ছেলে আশিকুর রহমান। ঘটনায় জড়িত থাকার অপরাধে প্রান্ত, নবু ও যুবায়ের নামে তিনজনকে আটক করে এসআই সুমন চক্রবর্তী। পরে ওসির নির্দেশে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা নিয়ে তাদের থানা থেকে ছেড়ে দেয়া হয়।

এছাড়াও বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জামসা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. আতিককে আটক করে এসআই সুমন চক্রবর্তী। তাকে হত্যা ও একাধিক নাশকতা মামলায় গ্রেফতারের ভয় দেখানো হয়। পরে এসআই সুমন ওসির সঙ্গে যোগসাজশে আতিকের পরিবারের কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।

একইভাবে ধল্লা ইউনিয়নের মো. ইউনুসকে আটক করে এসআই সুমন। ইউনুসকেও হত্যাসহ একাধিক মামলায় জড়ানোর ভয় দেখিয়ে ১ লাখ টাকা আদায় করে। পরে ওসির নির্দেশে ধল্লা পুলিশ ফাঁড়ি পোড়ানো মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।

গত বছরের ১৮ অক্টোবর সিংগাইর উপজেলার ভাকুম এলাকার ভাই-ভাই জেনারেল স্টোরের মালিক মো. জয়নালের বিরুদ্ধে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ করে স্থানীয়রা ৯৯৯-এ ফোন করে। পরে ওসির নির্দেশে তাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসেন এসআই সুমন ও মাসুদুর রহমান। আটক জয়নালের পরিবারের কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা নিয়ে ৫৪ ধারায় তাকে আদালতে প্রেরণ করা হয়।

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, সিংগাইরের একটি সি.আর মামলার আসামী মীর মো. শাজাহান, মীর বাবু, আতাউল হক ও মো. আমিনকে গত বছরের ২ অক্টোবর গ্রেফতার করে এসআই সুমন। এদের মধ্যে মীর শাহজাহান ও মীর বাবু পিতা-পুত্র। পরে পিতা মীর শাহজাহানের সামনে ছেলে মীর বাবুকে থানার ভেতরেই প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয়। নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে ওসি জাহিদুল ইসলাম ও এসআই সুমনকে দুই লাখ টাকা উৎকোচ দেয় তাদের পরিবারের লোকজন। এছাড়া আতাউল হক ও মো. আমীনের পরিবারের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে ১ লাখ টাকা আদায় করে ওসি জাহিদুল ইসলাম ও এসআই সুমন।

সিংগাইর উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ওয়াসিমকে আটক করে এসআই সুমন। তাকে হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় জড়ানোর ভয় দেখিয়ে তার পরিবারের কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় এসআই সুমন।

উপজেলার চর আজিমপুর এলাকার মহসীন খানকে আটক করে থানায় এনে বিভিন্ন মামলায় জড়ানোর ভয়ভীতি দেখায়। এর প্রেক্ষিতে মহসীনকে হত্যা মামলায় না জড়িয়ে ধল্লা পুলিশ ফাঁড়ি পোড়ানো মামলায় দিয়ে রিমান্ড না চাওয়ার শর্তে ওসির নির্দেশে এসআই সুমন ৮০ হাজার টাকা উৎকোচ গ্রহন করে মহসীনের স্ত্রী নিকট থেকে।

এছাড়া ধল্লা বাজারের হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী রমজানকে আটক করে থানায় এনে একাধিক মামলায় না দেয়া এবং রিমান্ড না চাওয়ার শর্তে রমজানের কাছ থেকে ১ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয় এসআই সুমন। এরপর রমজানকে পুলিশের ফাঁড়ি পোড়ানো মামলায় আদালতে প্রেরণ করা হয়।

একইভাবে শায়েস্তা ইউনিয়নের ফরমান আলীকে আটকের পর একাধিক মামলায় না জড়িয়ে শুধুমাত্র ধল্লা পুলিশ ফাঁড়ি পোড়ানো মামলায় গ্রেফতার দেখানো হবে জানিয়ে ওসির নির্দেশে তার কাছ থেকে দুই লাখ টাকা ঘুষ নেয় এসআই সুমন। তালেবপুর ইউনিয়ন মো. শাহানুর বক্সকে আটক করে ৪০ হাজার টাকা উৎকোচ নেয় এসআই সুমন।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, উপজেলার মাধবপুরের সানোয়ার হোসেনের কাছ থেকে ২ লাখ,চর লক্ষ্মীপুর পোকা সাঈদের নিকট থেকে ৬ লাখ, জামির্ত্তা রামকান্তপুরের আব্দুস ছামাদের নিকট থেকে ৭০ হাজার, কিটিংচরের জসিম উদ্দিন পাখির কাছ থেকে ৬০ হাজার,কাংশার ইসমাইলের কাছ থেকে ৫০ হাজার,আজিমপুর গোলাম রসুলের ৫০ হাজার,গোলাইডাঙ্গা-বাস্তার তারেকের ৫০ হাজার, জামশার সিদ্দিক মোল্লার ৫০ হাজার,তালেবপুর হুমায়ুন মেম্বারের কাছ থেকে ৫০ হাজার,চর লক্ষীপুর জিন্নতের ২৫ হাজার,আজিমপুরের রশিদ মোল্লা থেকে ৩৪ হাজার ও আলমের কাছ থেকে ৩২ হাজার,চর আজিমপুর সামছুলের ৩০ হাজার, জয়মন্টপ মঞ্জুরুল ইসলামের ৩০ হাজার, এছাড়াও সোহেল,নজরুল ভেন্ডার, আমজাদ হোসেন, রিয়াদ মেম্বারসহ প্রায় সকলের কাছ থেকেই টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।

পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া আসামীরা জেল-হাজতে থাকাবস্থায় তাদের পরিবারের কাছ থেকে পুনরায় টাকা দাবী করার অভিযোগ ওঠেছে। চাহিদামতো টাকা না পেলে হাজতি আসামীদের শ্যোন আরেস্ট দেখানোর তথ্য মিলেছে।

জামির্ত্তা ইউনিয়নের খালিদ মাহমুদ খোকনের পরিবার অভিযোগ করে বলেন,খোকনকে গ্রেপ্তারের পর ৫ লাখ টাকা দাবী করে ওসি জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গী। ওই টাকা না দেয়ায় তাকে ২০১৩ সালে গোবিন্দলের হত্যা মামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ড চাওয়া হয়। বর্তমানে সে জামিনে এসে পুলিশের ভয়ে আত্মগোপনে রয়েছে বলে জানা গেছে ।

অপরদিকে, মামলার এজাহারভূক্ত আওয়ামীলীগের অনেক নেতা-কর্মী থানা-পুলিশকে ম্যানেজ করে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিংগাইর থানায় দায়েরকৃত সবগুলো রাজনৈতিক মামলার দায়িত্ব দেয়া হয় ওসি জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীরের আস্থাভাজন এসআই সুমন চক্রবর্তী, মুত্তালিব ও মাসুদুর রহমান মাসুদকে। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক মামলায় গ্রেফতারকৃত আসামীদের হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে প্রায় কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি।

বিভিন্ন আসামীদের আটকের পর তাদের আত্মীয়-স্বজনরা থানায় আসলে তাদেরকে রাত ১০টার পরে থানার সামনের স্কুলমাঠে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন শর্র্তে অর্থ আদায় করে সিন্ডিকেটের সদস্য এসব এসআইরা। অবস্থাভেদে আসামীদের কাছ থেকে ৩০ হাজার থেকে শুরু করে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। এছাড়া আসামী ধরার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মামলার বাদির কাছে থেকেও অর্থ আদায় করতো ওসির এই সিন্ডিকেট বাহিনী।

জানা গেছে, কিছুদিন পূর্বে সাভার থেকে অজ্ঞাতনামা ৫ জনকে গ্রেফতার করে মোটা অংকের ঘুষ দাবি করে ওসি। তারা ঘুষ দিতে অপরাগতা জানালে আদালতে প্রেরণ করে। এরপর তাদের জামিন হলে জেলগেট থেকে তাদেরকে ফের গ্রেফতার করে অন্য মামলায় চালান দেয়া হয়।

এছাড়া সিংগাইর পৌরসভার আজিমপুর এলাকার সাঈদ ওরফে পোকা সাঈদকে গ্রেফতারের পর ওসি জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীর নিজের রুমে সাঈদকে নিয়ে বাকি সবাইকে বের করে দিয়ে ২০ লাখ টাকা দাবি করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় থানায় দালালি করা সাঈদকে হত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার ভয় দেখানো হয়। ভয়ে ৬ লাখ টাকা দিতে রাজি হয় সাঈদ। পরে রাতের আধারে সাঈদের স্ত্রী থানায় গিয়ে সেই টাকা পৌছে দেয়। এ ঘটনায় স্থানীয়দের মাঝে কানাঘূসা শুরু হলে পরবর্তীতে তাকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। জামিনে বের হয়ে পুনরায় গ্রেফতারের ভয়ে আবারও ওসিকে ৫০ হাজার টাকা দেয় সাঈদ। বর্তমানে এই সাঈদের মাধ্যমে সিংগাইরের আওয়ামী লীগের পালিয়ে থাকা নেতাদের কাছ থেকে গোপনে অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে ওসি বিরুদ্ধে।

এ ব্যাপারে সহকারী পুলিশ সুপার (সিংগাইর সার্কেল) নাজমুল হাসানের কাছে জানতে চাইলে তিনি গণমাধ্যমকে ওসির প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।



banner close
banner close