
মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের বাল্লা ইউনিয়নের সরফদিনগর গ্রামে মো. আমজাদ হোসেন (৩৮) নামের এক যুবকের হত্যাকান্ড নিয়ে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এলাকার হাটবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে চলছে নানা আলোচনা সমালোচনা। তবে এলাকার এসব আলোচনা সমালোচনা থেকে এই হত্যাকান্ডের পেছনে পরকীয়া প্রেমের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে এলাকার একাধিক ব্যক্তি সন্দেহ করছেন।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, এই গ্রামের সৌদি প্রবাসী উজ্জ্বল খানের দ্বিতীয় স্ত্রী সাজেদা বেগম (৪০) এর সাথে নিহত আমজাদ হোসেনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এই সম্পর্কের জের ধরেই তাদের মধ্যে পরকীয়া চলছিল। শুধু তাই নয়, নিহত আমজাদ হোসেন ওই নারীর সাথে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতেন। আমজাদ হোসেনের ফেসবুক আইডিতে ওই নারীর ছবি ব্যবহার করে টিকটকে বিরহের একটা ভিডিওর সন্ধানও মিলেছে। এই হত্যাকান্ডের পরের দিন ১২ ফেব্রুয়ারি বুধবার রাত নয়টার দিকে এলাকা থেকে পরকীয়া প্রেমিকা সাজেদা বেগম উধাও হয়েছে বলেও জানান একাধিক এলাকাবাসী। এতে করে এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় এলাকাবাসীসহ পুলিশের সন্দেহের তীর এখন অনেকটা সাজেদার দিকে।
রহস্যজনক এ হত্যাকান্ড নিয়ে অনুসন্ধানে এলাকার একাধিক সূত্রে জানায়, প্রায় ত্রিশ বছর আগে সরফদিনগর গ্রামের মঙ্গল খানের প্রথম স্ত্রী অসুস্থতাজনিত কারণে মারা যাওয়ার বছর তিনেক পরে শিবালয় উপজেলার নয়াকান্দি গ্রামের সাজেদা বেগমকে বিয়ে করেন তিনি। বিয়ের পরে তাদের দশ বছরের দাম্পত্য জীবনে এক ছেলে ও তিন মেয়ের জনক জননী হন মঙ্গল-সাজেদা দম্পত্তি। মঙ্গল খানের প্রথম স্ত্রীর ঘরেও দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
দ্বিতীয় বিয়ের দশ থেকে বারো বছরের মধ্য মারা যান মঙ্গল খান। তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় তার ভাতিজা হোসেন খানের ছেলে উজ্জ্বল খানের সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন দ্বিতীয় স্ত্রী সাজেদা বেগম। এই পরকীয়া প্রেমের জের ধরেই ঘুমের ওষুধ খাইয়ে উজ্জ্বল-সাজেদা হত্যা করে মঙ্গল খানকে। ওই সময় এলাকায় ঘটনাটি নিয়ে বেশ তোলপাড় সৃষ্টি হলেও অদৃশ্য কারণে তা চাপা পড়ে যায়। মঙ্গল খান মারা যাওয়ার বছর খানেক পরেই ওই পরকীয়া প্রেমিক নাতি উজ্জ্বল খানের সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন সাজেদা বেগম। উজ্জল খানেরও দ্বিতীয় স্ত্রী হন এই সাজেদা বেগম। নাতি উজ্জ্বলের সাথে বিয়ে হলেও তিনি ছেলেমেয়ে নিয়ে বসবাস করেন সাবেক স্বামী মঙ্গল খানের বাড়িতেই। উজ্জ্বলের সাথে বিয়ের এক বছর না পেরোতেই সাজেদা বেগম কাজের জন্য পাড়ি জমান সৌদি আরবে। প্রায় এক বছর সৌদি আরবে থেকে তিনি দেশে ফিরে আসেন। তার বছরখানেক পর সৌদি আরব চলে যায় স্বামী উজ্জ্বল খান। এরপরেই বেপরোয়া হয়ে উঠেন সাজেদা বেগম। সম্পর্ক গড়ে তোলেন একাধিক পুরুষের সাথে। নিহত আমজাদ হোসেন ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালানোর সুবাদে তাকে নিয়ে ওই নারী বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতেন। এভাবেই আমজাদের যাতায়াত শুরু হয় সাজেদা বেগমের বাড়িতে। এক পর্যায়ে তাদের মাঝে সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। শুধু আমজাদই নয়, সাজেদা বেগমের বাড়িতে এলাকার একাধিক যুবকেরই যাতায়াত ছিল বলে স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানায়।
সরফদিনগর গ্রামের বাসিন্দা জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস) এর হরিরামপুর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাব্বির আহমেদ লিটন জানান, মঙ্গল খানের সাবেক স্ত্রী সাজেদা বেগম খুবই খারাপ একজন মহিলা। এলাকার অনেক ছেলের সাথে তার সম্পর্ক। আমজাদও ওই বাড়িতে যাতায়াত করতো এবং তাকে নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াতো। সাজেদার জন্য আমাদের এলাকার যুব সমাজ ধ্বংসের পথে। মান সম্মানের ভয়ে কেউ কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না। আমজাদ হত্যার একদিন পরেই ওই নারী সাজেদা বেগম মোবাইল বন্ধ করে এলাকা থেকে পালিয়েছে। আর কেউ কিন্তু এলাকা ছাড়েনি, অথচ ওই মহিলা পলাতক। তাই আমজাদ হত্যাকান্ডের সাথে সে জড়িত থাকতে পারে। এছাড়াও এই মহিলা তার সাবেক স্বামী মঙ্গল খানকেও ঘুমের ঔষধ খাওয়াইয়ে মেরে ফেলেছে এমনটাও পূর্বে শোনা গেছে। তাই এই নারীকে আটক করলে আমজাদ হত্যার রহস্য বেরিয়ে আসতে পারে।
সরফদিনগর গ্রামের বাসিন্দা বাংলাদেশ সুষম উন্নয়ন ফোরামের সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম রফিক জানান, আমজাদ হত্যাকান্ড এটা একটা রহস্যজনক ঘটনা৷ অনেক আগে থেকেই লোক মুখে প্রচারিত আছে, আমজাদের সাথে প্রয়াত মঙ্গল খাঁনের সাবেক স্ত্রী সাজেদা বেগমের পরকীয়া সম্পর্ক ছিলো। শুধু আমজাদ নয়, এই নারী মঙ্গল খাঁনের দ্বিতীয় স্ত্রী হয়ে আসার পর থেকেই এলাকার অসংখ্য ছেলের সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত ছিল। এরকম জঘন্যতম একজন নারী সম্পর্কে মন্তব্য করতেও রুচিতে বাঁধে! এলাকায় কথিত আছে, মঙ্গল খানের ভাতিজার ছেলে বর্তমান স্বামী উজ্জ্বলের সাথেও অতীতে এই নারী পরকীয়ায় লিপ্ত হন। তাদের পরকীয়ায় পথ নির্বিঘ্ন করতে এই সাজেদা বেগম তাঁর সাবেক স্বামী মঙ্গল খানকেও ঘুমের ওষুধ খাওয়ায়ে মেরে ফেলেছে বলেও পূর্বে শোনা গেছে। মঙ্গল খাঁনের প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর এই দুশ্চরিত্রা মহিলাকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এই মহিলার কারণে এলাকার যুব সমাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই আমজাদ হত্যার বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের শাস্তির দাবি করছি। যাতে ভবিষ্যতে এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।"
নিহতের বাবা বেলায়েত হোসেন জানান, তাদের সম্পর্কের বিষয়টি আমাদের আগে জানা ছিল না। তবে আমজাদ হত্যার পরে এখন লোকমুখে বিষয়টি আমরা শুনতেছি। তবে হত্যার ঘটনার পর থেকে ওই নারী সাজেদা বেগম এলাকা থেকে পলাতক রয়েছে। তাতে এঘটনার সাথে সে জড়িত থাকতে পারে। আর প্রেমের বিষয়টিও সত্য হলেও হতে পারে। ওই মহিলাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে হয়তো আসল রহস্য বের হয়ে আসতে পারে। এছাড়াও একটা ফোনকল পেয়ে সে ছুটে যায়। তাই কার ফোনে সে বাড়ি না এসে কোথায় চলে যায়, এটা বের করতে পারলেই হয়তো আসল ঘটনা জানা যাবে। আমি প্রকৃত ঘটনা উন্মোচন করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি।
হরিরামপুর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ মুমিন খান জানান, এ হত্যাকান্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করতে বিভিন্নভাবে তদন্তের কাজ চলছে। বেশ কয়েকটি ইস্যু নিয়ে আমাদের তদন্ত কাজ চলমান রয়েছে। পরকীয়ার বিষয়টিও আমরা শুনেছি। সবগুলো বিষয় নিয়েই আমরা তদন্তের কাজ করছি। আশা করছি, খুব শীঘ্রই এ হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচন করতে পারব, ইনশাআল্লাহ।
উল্লেখ, গত ১০ ফেব্রুয়ারি (সোমবার) দিবাগত রাতের যেকোনো সময় হত্যার শিকার হন আমজাদ হোসেন। পরের দিন মঙ্গলবার সকালে উপজেলার বাল্লা ইউনিয়নের সরফদীনগর ও শ্রীকৃষ্ণপুর এলাকার মাঝে পিঁয়াজ ক্ষেতের পাশে ডাঙ্গার পাড়ে আমজাদ হোসেনের মরদেহ দেখতে পান স্থানীয়রা। পরে পরিবারকে জানালে পরিবারের লোকজন ছুটে আসে এবং পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়। ময়না তদন্ত শেষে ওই দিন রাতেই লাশ দাফন করা হয় এবং নিহতের বাবা বেলায়েত হোসেন বাদী হয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ২। মামলায় সন্দেহভাজন একজনসহ অজ্ঞাত আরও ৩/৪ জনকে আসামী করা হয়।
এ ঘটনার পর বুধবার রাত থেকেই পলাতক রয়েছে পরকীয়া প্রেমিকা সাজেদা বেগম।
আরও পড়ুন: