
লক্ষ্মীপুর জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি একেএম সালাহউদ্দিন টিপুর বাসভবন 'পিংকি প্লাজা' এবার আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে। জেলা জুড়ে উন্মোচিত হয়েছে শীর্ষ এই সন্ত্রাসীর স্বরুপ। কথিত আছে, নিজ দলের কিংবা বিরোধী মতাদর্শের লোকজনকে ধরে এনে এ বাড়িতে আটকে নির্যাতন করা হতো। গত ৬ ফেব্রুয়ারী আলোচিত ভবনটির একাংশ ভেঙে দিয়েছে জনতা।
শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সকালে ভাঙা বাড়িটি রোদের আলোয় খুব পরিস্কার চোখে দেখেছে স্থানীয়রা। এর আগে গত ৫ ফেব্রুয়ারী শেখ হাসিনার দেওয়া বক্তব্যের জেরে বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) বিকেল ৫টার পর থেকে বাড়িটি ভাঙা শুরু করে উত্তেজিত জনতা। বাড়ির ছাদে এবং নিচে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
দিনের আলোতে হাতুড়ি-শাবল দিয়ে ভাঙা শুরু করলেও সন্ধ্যার পর ভেক্যু মেশিন দিয়ে বিশালাকৃতির বাড়ির সামনের অংশ ভেঙে ফেলা হয়।
স্থানীয়রা জানায়, সেদিন রাত থেকেই উৎসুক লোকজন ওই ভবনে থাকা লোহা ও স্টিলের তৈরি বিভিন্ন মালামাল লুটে নেয়। এছাড়া ভোর থেকে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী লোকজন কেটে ফেলে ভাঙা অংশের রড।
স্মৃতি ধরে রাখতে কেউ কেউ ইটের ভাঙা অংশ নিয়ে যায়। পিংকি প্লাজা নামের এ বাড়ির ছাদ থেকেই গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করা হয়। টিপুর করা গুলিতে তিন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। আহত হয় তিন শতাধিক ছাত্র-জনতা। শহরের মাদাম এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় আরেক শিক্ষার্থী।
জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন সালাহউদ্দিন টিপু। এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে তার কুখ্যাতি আছে। টিপু সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এবং লক্ষ্মীপুরের বহুল আলোচিত পৌর মেয়র প্রয়াত আবু তাহেরের মেঝ ছেলে।
আবু তাহেরের পিংকি প্লাজা গত তিন দশক ধরে আলোচিত। এক সময়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল এ বাড়িটি। ৯৬ সালের দিকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবু তাহের এ বাড়ি থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। সে সময় তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র ছিলেন। জেলায় একছত্র অধিপত্য ছিল তার। তখনকার সময়ে আলোচিত বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা এ বাড়ি থেকেই হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তাহেরের বড় ছেলে আফতাব উদ্দিন বিপ্লব নুরুল ইসলামকে ধরে এনে এ বাড়িতে আটকে রাখেন। পরে সুবিধাজনক সময়ে তাকে হত্যা করে মরদেহ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
স্থানীয় এক বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী রায়হান হোসেন বলেন, পিংকি প্লাজা ছিলো লক্ষ্মীপুরের আয়নাঘর। সন্ত্রাসী টিপুর প্রয়াত বাবা এই আয়নাঘরের জন্মদাতা।
পরবর্তীতে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে এ বাড়িটির একাংশ ভেঙে ফেলা হয়। বিএনপি সরকারের সময়ে বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। তখন জমির মালিকানা নিয়েও বিতর্ক দেখা দেয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে এ বাড়িটি পুনরায় সংস্কার ও পরিধি বৃদ্ধি করা হয়। আবু তাহেরের জীবদ্দশায় এ বাড়ি থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে আসছেন। বাড়িটিতে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের উপচেপড়া ভিড় ছিল। আবু তাহেরের পাশাপাশি তার মেঝ ছেলে টিপু এ বাড়ি থেকে যুবলীগের রাজনীতি করে আসছেন। তখনও বাড়িটি নেতাকর্মীদের পদচারণায় মুখরিত ছিল।
গত ৪ আগস্ট ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন সময়ে টিপু তার সমর্থিত লোকজনকে নিয়ে এ বাড়ি থেকেই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি করে। এসময় আন্দোলনকারী হাজার হাজার ছাত্র-জনতা বাড়িটি ঘিরে রাখে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। দিনব্যাপী গুলিবর্ষণের এক পর্যায়ে টিপু কৌশলে পালিয়ে যায়। ওইদিন গভীর রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে বাড়িটির ছাদ থেকে প্রায় ২৮ জনকে উদ্ধার করে। পরদিন ৫ আগস্ট বিকেলে পুনরায় বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা। লুটপাট করা হয় বিভিন্ন সামগ্রী। এরপর থেকে বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল।
আরও পড়ুন: