শুক্রবার

২৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১০ পৌষ, ১৪৩২

পঞ্চগড়ে ‘ফিল্মি’ স্টাইলে বাড়িঘর ভাঙচুর-লুটপাট, পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা না নিয়ে ভুক্তভোগীদের হেনস্থার অভিযোগ

সুজন মাহমুদ, পঞ্চগড় প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১২ জানুয়ারি, ২০২৫ ১১:৫৭

আপডেট: ১২ জানুয়ারি, ২০২৫ ১২:৩৩

শেয়ার

পঞ্চগড়ে ‘ফিল্মি’ স্টাইলে বাড়িঘর ভাঙচুর-লুটপাট, পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা না নিয়ে ভুক্তভোগীদের হেনস্থার অভিযোগ
ছবি: বাংলা এডিশন

জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে পঞ্চগড়ে বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে এবং ওই জমির মামলা আদালতে চলমান থাকলেও স্থানীয় পুলিশ আইনবহির্ভূতভাবে সালিশি মীমাংসার নামে হামলাকারীদের পক্ষ নিয়েছেন বলে ভুক্তভোগী ও অভিযোগ করেছেন।

এছাড়া হামলার দুইদিন পার হয়ে গেলেও পুলিশ মামলা না নিয়ে উল্টো ভুক্তভোগীদের হয়রানি করার অভিযোগ ওঠেছে।

বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) সকালে জেলার সদর উপজেলার মনোহরদিঘী এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

হামলার দুই দিন পর খবর পেয়ে শনিবার স্থানীয়দের সঙ্গে সরেজমিনে গিয়ে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে মো. রশিদুল ইসলামের (৪৮) সঙ্গে সাইফুল ইসলামের পরিবারের জমি নিয়ে বিরোধ চলে আসছিলো।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী সাইফুল ইসলাম বাংলা এডিশনের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘সেই জমিজমার বিরোধের জের ধরে ওই দিন দুপুরে প্রায় এক থেকে দেড়শো জন লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে রশিদুল আমাদের জমি দখল করতে আসে। পরে তারা আমাদের বাঁধার মুখে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে অতর্কিত হামলা চালিয়ে আমার পরিবারের লোকজনকে ব্যাপকভাবে আহত করে। যার মধ্যে ৭জন পঞ্চগড় সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে।’

তিনি বলেন, ‘রশিদুলের সঙ্গে আসা লাঠিয়ালরা আমাদের বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে ঘরে থাকা বিভিন্ন দামী জিনিসপত্র, গোয়ালের গরু, ইজিবাইক ও টাকা পয়সা লুটপাট করে নিয়ে যায় এবং আমাদের জমির দলিল ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘রশিদুল ওই সময় পাঁচটি বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়ে নগদ ২ লাখ ৬৬ হাজার টাকা, ২ ভরি স্বর্ণালংকার (বর্তমান বাজার মূল্য আড়াই লাখ টাকা), ইজিবাইক ও পাগলু গাড়ি, পাঁচটি গরু, ছোট ভাইয়ের সঞ্চয়ের ৯৫ হাজার টাকা, সাত বস্তা টিএসপি সার লুটপাট করে নিয়ে যায়।

‘ইজিবাইকটা তারা ইউনিয়ন পরিষদে দিয়ে গেছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আমাকে বলা হচ্ছে সেটি নিয়ে আসতে। পরে আমি বাদী হয়ে ওই দিন রাতেই পঞ্চগড় সদর থানায় অভিযোগ দিতে গেলে থানা পুলিশ অভিযোগ না নিয়ে আমাদের ফিরিয়ে দেয়।’

সাইফুল ইসলামের বোন আজিমা খাতুন ও সালমা আক্তার বলেন, ‘ওই দিন দুপুরে রশিদুল লোকজন নিয়ে এসে আমাদের বাড়িতে আমার ভাইদের ওপর আক্রমণ করে। আমার এক ভাই খাইতে বসছিলো সেখানে এসে তাকে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে মারধর করে। আমার আরেক ভাই খাটের নিচে লুকিয়ে ছিল ওরেও টেনেহিঁচড়ে বের করে অনেক মারপিট করে। আমরা এর সঠিক বিচার চাই।’

রশিদুল ও তার লাঠিয়ালদের হামলার শিকার আরেক ভুক্তভোগী কোহিনূর আলম বলেন, ‘এখানে হাফিজাবাদ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ইসমাইল হোসেনের সরাসরি ইন্দন রয়েছে। চেয়ারম্যানের নির্দেশেই এ হামলা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টির ওই চেয়ারম্যান বলে দিয়েছিলেন তোমরা যা ইচ্ছা কর, পরে আমি দেখবো। ঘটনার সময় ৯৯৯ এ কল দিলে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে নীরব ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে কয়েকজন পুলিশ আমাদের ওপর ও বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুরের ভিডিও ধারণে ব্যস্ত থাকে। তারপর আমরা থানায় অভিযোগ দিতে গেলে এসআই কাইয়ুম বলেন কোনো অভিযোগ নেওয়া হবে না।

‘এ সময় এসপি বলেছেন তোমাদের জমিজমার বিষয় রোববার বসে মিমাংসা করে দেওয়া হবে। আজ দুইদিন পার হয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত পুলিশ আমাদের মামলা তো দূরের কথা অভিযোগ টাও নেয়নি।’

অভিযোগের বিষয়ে হাফিজাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান ইসমাইল হোসেন বাংলা এডিশনকে বলেন, ‘ঘটনার দিন আমাকে বারবার কল দিয়ে জানানো হয়। পরে আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি পুলিশের এসপি, এসআইসহ অনেকেই আছে। পরে তারাই (পুলিশ) উভয় পক্ষকে বলল যে- যে যে অবস্থায় আছেন থাকেন; রোববার বসে আপনাদের এটা মিমাংসা করে দেওয়া হবে৷’

কোর্টে মামলা চলমান থাকা অবস্থায় জমির সালিশি বৈঠকে মিমাংসার সুযোগ কিংবা নিয়ম আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘না, এটা নিয়ম নাই। তবে একটা ধারা আছে যা দিয়ে সালিশি বৈঠকের মাধ্যমে মিমাংসা করা যায়। তবে আমার এই মূহুর্তে ধারাটা মনে নাই।’

পুলিশের এমন আচরণ ও মামলা না নেওয়ার বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন স্থানীয় নাছির উদ্দীন ও শহিদুরসহ অনেকে।

তারা বাংলা এডিশনের কাছে অভিযোগ করে জানান, ‘আমরা আশাবাদী ছিলাম যে পুলিশ অন্তত মামলাটা নিবে; কিন্তু, মামলা না নেওয়ায় আমরা খুবই হতাশ। যাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে তারা প্রকৃতপক্ষেই অনেক ভালো মানুষ। এখন আমাদের দাবি- তারা যেন আপনাদের মাধ্যমে ন্যায় বিচার পায়।’

ওই হামলার সময় আরেক প্রত্যক্ষদর্শী জয়নুল ইসলাম বলেন, ‘যারা এদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে তারা আগে থেকেই খারাপ লোক, আওয়ামী লীগ করে। যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল তারা বিভিন্নভাবে সবাইকে চাপে রাখতো, মামলার হুমকি দিতো। ভয়ে কেউ কথা বলতে পারতো না। এখন হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলেও তাদের পূর্বের মতো দাপট দেখে আমরা বিস্মিত।’

মামলা না নেওয়ার বিষয়ে প্রথমে পঞ্চগড় সদর থানার তদন্ত ওসি এইচ এস এম সোরওয়ার্দীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘এটা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শফিক স্যার নিতে নিষেধ করেছেন। এখন উনি যেহেতু আমার সিনিয়র আমি তো কথা বলতে পারি না। আপনারা উনার সাথে কথা বলেন।’

মামলা না নেওয়া এবং কোর্টে জমিজমার মামলা চলমান থাকলে পুলিশ মিমাংসা করতে পারে কিনা জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) এসএম শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আচ্ছা আপনি ঢাকায় বাংলা এডিশনের সাংবাদিক, আপনি কি জমিজমা সংক্রান্ত নিউজ করেন নাকি? আপনি বার বার আমাকে ফোন দিচ্ছেন! আপনি জানতে চাইলে অফিসে এসে কথা বলবেন। জমিজমা সংক্রান্ত বিষয় আপনি পুলিশকে ফোন দেন কেন বার বার!’

অন্য আরেকটা প্রশ্নের সময় তিনি জবাব না দিয়ে ফোন রেখে দেন।

জমিজমা নিয়ে আদালতে মামলা চলমান থাকলে সেখানে পুলিশ গিয়ে মীমাংসা করতে পারে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে পঞ্চগড় দায়রাজজ আদালতের আইনজীবী মনিরুজ্জামান বলেন, ‘এমন কোনো বিধান নেই। আদালতের নির্দেশ ছাড়া পুলিশ বা অন্য কোনো পক্ষ জমি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ওই জমি বাদী বা বিবাদী, কোনো পক্ষই ব্যবহার করতে পারবে না। যেই পক্ষ মামলায় জয়লাভ করবে, জমি তারাই ভোগদখল করবে।’



banner close
banner close